বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে! কথায় কথায় রাজনৈতিক নেতাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, লাগামহীন বক্তব্যে, মিছিল, সমাবেশের ডাক দিয়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারকে চাপ সৃষ্টি করে দাবি আদায়ের কৌশলকে স্বাভাবিকভাবে দেখছেন না রাজনৈতিক দলগুলো। বিশেষ করে বিএনপি’র সঙ্গে সমন্বয়কদের দুরত্ব দিনদিন বাড়ছে। বিএনপি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলেনর সমন্বয়কদের রাজনৈতিক অভিলাষকে সন্দেহের চোখে দেখছে। ফলে সমন্বয়কদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা ভর করেছে। মাত্র তিন মাসের মধ্যে এখন তারা চোখের সামনে ফাঁসির রশি দেখছে! তার প্রমাণ মিলে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহবায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ’র এক ফেসবুক পোস্টে।
গত মঙ্গলবার বেলা আড়াইটার দিকে ফেসবুকে এই সমন্বয়ক লিখেন, ‘রাজনীতিবিদরা হাত মেলাচ্ছে, আর বিপ্লবীদের ফাঁসির দড়ি এগিয়ে আসছে।’
হাসনাত এই পোস্টের কমেন্টবক্সে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড এবং অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপগুলো নিয়ে সন্দেহ এবং হতাশা প্রকাশ করেছে বলে অনেকে মন্তব্য করছেন।
এর আগে সোমবার রাতে নিজের ফেসবুক প্রোফাইলের ছবি লাল করে হাসনাত আব্দুল্লাহ লিখেন, ‘সাঈদ ওয়াসিম মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ। ১৩৪ জুলাই, ২৪।
প্রসঙ্গত, গত জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতাকে নির্বিচারে হত্যার প্রতিবাদে ফেসবুক প্রোফাইল লাল করেছিলেন হাসনাতসহ অন্য সমন্বয়করা। এসময় আন্দোলনের সমর্থন দেয়া অসংখ্য মানুষ তাদের প্রোফাইল একইভাবে লাল করেছিলেন।
এদিকে প্রোফাইল লাল করার কিছুক্ষণ আগে আরেকটি পোস্টে উপদেষ্টা পরিষদে আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেখ বশির উদ্দিন ও চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে জায়গা দেয়ার সমালোচনা করেন তিনি।
সেখ বশির উদ্দিন ও মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা করার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে ‘তাওহিদি ছাত্র জনতা’-এর ব্যানারে আয়োজিত এক সভা পণ্ড হয়ে যায়। সোমবার ওই সভা থেকে পাঁচ জনকে আটক করে পুলিশ।
হাসনাত লিখেন ‘বশির-ফারুকীকে উপদেষ্টা করার প্রতিবাদ সভা থেকে গ্রেফতার করার ঘটনা চরম ফাইজলামি। এগুলা ভণ্ডামি। আপনেরা হাসিনা হয়ে উঠার চেষ্টা কইরেন না। হাসিনারেই থোরাই কেয়ার করছি, উৎখাত করছি। আপনেরা কোন হনু হইছেন?’
একটি সংবাদ মাধ্যমকে হাসনাত বলেন, ‘রাজনৈতিক বন্দোবস্ত এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি করা হয়েছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সংবিধানপ্রীতি, মুজিবের ছবি সরানোর কারণে আমরা দেখলাম যে, গত ১৬ বছর ধরে গণতন্ত্রের জন্য এই সংবিধানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা একটি দলের মাঝে এখন একটা প্রীতি দেখা যাচ্ছে। দেখলাম যে একটা বক্তব্য দেয়া হয়েছে যে, শেখ মুজিবের ছবি সরানো ঠিক হয়নি। মোস্তাকের সঙ্গেও তুলনা করা হচ্ছে যে, মোস্তাক এই কাজ করেছিল। এই বিষয়গুলো দুঃখজনক।’
রাজনীতিবিদরা অগ্রজ এবং অনুজের মাঝে বিভাজন তৈরি করছেন বলেও অভিযোগ করেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহবায়ক। এই বিষয়গুলো কোথাও না কোথাও বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটে ঘাটতি তৈরি করছে বলে উল্লেখ করেন হাসনাত।
এছাড়া বর্তমান সংবিধানের অধীনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেন হাসনাত। এক পোস্টে তিনি লিখেন, ‘আমরা সারাদিন লীগ তাড়াবো আর বলবো মুজিববাদ, মুর্দাবাদ।’ আর তারা মুজিবের ছবি পিছনে টানিয়ে করে শপথ পাঠ।
প্রসঙ্গত, গত ১০ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির বাসভবন বঙ্গভবনের দরবার হল থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরিয়ে ফেলা হয়। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে সদ্য শপথ নেয়া মাহফুজ আলম এক ফেসবুক পোস্টে লিখেন, ‘৭১ পরবর্তী ফ্যাসিস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দরবার হল থেকে সরানো হয়েছে। এটা আমাদের জন্য লজ্জার যে আমরা ৫ আগস্টের পর বঙ্গভবন থেকে তার ছবি সরাতে পারিনি। তবে মানুষের ভেতরে জুলাই স্পিরিট যতদিন থাকবে তাকে আর কোথাও দেখা যাবে না।’
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নামিয়ে শপথ ভঙ্গ করেছেন সদ্য শপথ নেয়া দপ্তরবিহীন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। কেননা, যে সংবিধান রক্ষা করার জন্য তিনি শপথ নিয়েছেন। সংবিধানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি টাঙ্গানো বাধ্যতামূলক। সংবিধান স্থগিত বা বাতিল করা হয়নি।
ওই ঘটনা নিয়ে গত মঙ্গলবার সকালে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘জাতীয় পর্যায়ে যাদের অবদান আছে, তাদের স্বীকার করতেই হবে। কেউ অপরাধ করলে ইতিহাস ও জনগণ তা সিদ্ধান্ত নেবে। আওয়ামী লীগের মত সংকীর্ণমনা দল বিএনপি নয়। বঙ্গভবন থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নামানো ঠিক হয়নি। খন্দকার মোশতাকও তার ছবি নামিয়েছিলেন আর জিয়াউর রহমান আবার টাঙিয়েছিলেন সেই ছবি।’
তবে কিছুক্ষণ পরই নিজের ওই বক্তব্যের সংশোধনী দিয়ে আগের বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এক বিবৃতিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমি মনে করেছিলাম, বঙ্গভবনের দরবার কক্ষে যেখানে সব রাষ্ট্রপতির ছবি থাকে সেখান থেকে শেখ মুজিবের ছবি নামানো হয়েছে। মূলতঃ ছবিটি সরানো হয়েছিল বঙ্গভবনের অন্য একটি অফিস কক্ষ থেকে।’
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের তিন মাসের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বিএনপির এক ধরনের সন্দেহ- অবিশ্বাস দেখা দিয়েছে। এতে দেশে নতুন করে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
বিএনএ/ সৈয়দ সাকিব,ওজি/এইচমুন্নী