বিএনএ ডেস্ক: ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের নেয়া জ্বালানি খাতের ৪টি মেগা প্রকল্প বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এগুলো হচ্ছে-কক্সবাজারে অবস্থিত সামিট পাওয়ারের তৃতীয় এলএনজি টার্মিনাল (এফএসআরইউ), এস আলম গ্রুপের ইস্টার্ন রিফাইনারির ‘ইনস্টলেশন অব ইআরএল ইউনিট-২’ এবং ভোলায় রাশিয়ান কোম্পানি গ্যাজপ্রমের ৫টি কূপ খনন প্রকল্প। এছাড়া বাতিলের তালিকায় আছে একক কোম্পানিকে দিয়ে ভোলার গ্যাস সিএনজি আকারে আনার সিদ্ধান্ত। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সামিটের তৃতীয় এফএসআরইউ
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক বৈঠকেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের আলোচিত এই প্রকল্পটি বাগিয়ে নিয়েছিল সামিট গ্রুপ। কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা ও যাচাই-বাছাই ছাড়াই মাত্র ১০ দিনের প্রক্রিয়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর একক সিদ্ধান্ত ও চাপে ১৭ হাজার কোটি টাকার এলএনজি টার্মিনালের কাজ দেয়া হয় সামিটকে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধির (বিশেষ আইন) আইন ২০১০ এর আওতায় তৎকালীন সরকার এই সিদ্ধান্ত নেয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ৩০ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সভাকক্ষে (দ্বিতীয় তলা) ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর সভাপতিত্বে ‘গ্যাস পরিস্থিতি পর্যালোচনা সভা’ অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকেই মহেশখালীতে ভাসমান তৃতীয় এলএনজি টার্মিনালের কাজ সামিটে দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার পর পরবর্তী ১০ দিনের মধ্যে (১০ জুন) কারিগরি কমিটির প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। ওই বৈঠকে তৎকালীন জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব (বর্তমানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব) মো. মাহবুব হোসেন, তৎকালীন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান (বর্তমান পানিসম্পদ সচিব) নাজমুল আহসানসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘বিশেষ আইনে করা সব চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করা হবে। এজন্য ৫ সদস্যের একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে এ ধরনের প্রকল্পগুলো যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে। ফাওজুল কবির খান বলেন, আমরা এখন ভাসমান টার্মিনালের চেয়ে স্থলভাগে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের চিন্তা করছি। এখন থেকে সব হবে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায়।’
জানা গেছে, কক্সবাজারের মহেশখালীতে তৃতীয় এফএসআরইউ স্থাপনের জন্য বেশকিছু কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন জ্বালানি উপদেষ্টার নির্দেশে শুধু সামিটের প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই না করেই সামিটের প্রস্তাব আমলে নিয়ে তাদের কাজ দেয়া হয়। এমনকি সামিটকে কাজ দেয়ার সিদ্ধান্তের পর কারিগরি কমিটি প্রতিবেদন দেয়। নিয়ম অনুযায়ী কারিগরি কমিটির প্রতিবেদনের পর প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ ও কাজের অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়।
২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি কক্সবাজারের মহেশখালীতে দেশের তৃতীয় ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল বা এফএসআরইউ নির্মাণের খসড়া চুক্তি অনুমোদন করে। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুমোদিত খসড়া চুক্তি অনুযায়ী, টার্মিনাল চালুর পর থেকে ১৫ বছর মেয়াদে দৈনিক ৩ লাখ ডলার (চুক্তিতে উল্লিখিত বিনিময় হার অনুযায়ী ৩ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার টাকার সমপরিমাণ) রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ পাবে সামিট।
গ্যাজপ্রমের ৫ কূপ খনন প্রকল্প
জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ করার জন্য সঞ্চালন লাইন নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই এখনো শেষ হয়নি। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ দ্রুত শেষ করা হলেও ২০২৬ সালের আগে সঞ্চালন লাইন হচ্ছে না। কিন্তু জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর আশায় ভোলা গ্যাসক্ষেত্রে পাঁচটি কূপ খননের কাজ দেয়া হয় রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি গ্যাজপ্রমকে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেক্স) আবিষ্কার করা এ গ্যাসক্ষেত্রে বিনা দরপত্রে গ্যাজপ্রমকে কূপ খননের কাজ দেওয়া হয়।
বাপেক্সের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নিজস্ব লোকবল দিয়ে তাদের একটি কূপ খনন করতে সর্বোচ্চ খরচ হয় ৮০ কোটি টাকা। অন্যদিকে গ্যাজপ্রমকে দিয়ে কূপ খনন করতে গিয়ে খরচ হয় ১৮০ কোটি টাকার মতো। ২০২০ সালে তিনটি কূপ খননের জন্য গ্যাজপ্রমকে দিতে হয়েছে ৫৪০ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্রনাথ সরকার বলেন, সরকার গ্যাজপ্রর্মের বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নেবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে তিনি শুনেছেন যদি এই প্রকল্প বাতিল হয় তাহলে আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে কূপগুলো খনন করা হবে। তিনি আরো বলেন, আমাদের এখন খুবই গ্যাস ক্রাইসিস আছে। তাই টার্গেট হচ্ছে স্থানীয়ভাবে দ্রুত গ্যাস উত্তোলন করা। সেজন্য যদি কোনো প্রকল্প বাতিল হয়ে যায়, তাহলে যাতে সময়ক্ষেপণ না হয়, সেজন্য সবকিছু চূড়ান্ত করে রাখা হয়েছে।
ইআরএল ও এস আলম গ্রুপের প্রকল্প
ইস্টার্ন রিফাইনারি (ইআরএল) এবং এস আলম গ্রুপের যৌথ উদ্যোগে ‘ইনস্টলেশন অব ইআরএল ইউনিট-২’ শীর্ষক প্রকল্পের প্রস্তাব ইতোমধ্যে বাতিল করেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। ২৯ আগস্ট মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিউল্লাহ এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছেন।
এতে বলা হয়েছে, বিপিসির আওতাধীন ইআরএল কর্তৃক বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাবিত ‘ইনস্টলেশন অব ইআরএল ইউনিট-২’ শীর্ষক প্রকল্পটি বিপিসি/ইআরএল এবং এস আলম গ্রুপের মধ্যে সরকারি বেসরকারি যৌথ উদ্যোগী চুক্তির আওতায় বাস্তবায়ন প্রস্তাব বাতিলের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। একই সঙ্গে প্রকল্পটির ডিপিপি বৈদেশিক মুদ্রার হালনাগাদ রেট অনুযায়ী প্রাক্কলন এবং সব ক্রয় পরিকল্পনা পিপিআর-২০০৮ অনুযায়ী প্রণয়নপূর্বক পরিকল্পনা কমিশনে পুনর্গঠিত ডিপিপি পাঠানোর জন্য বিপিসিতে পত্র দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
একক কোম্পানিকে দিয়ে ভোলার গ্যাস সিএনজি আকারে আনার সিদ্ধান্ত : ভোলার গ্যাস সিএনজি (কম্প্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস) করতে আরো একাধিক কোম্পানিকে কাজ দেয়া হবে। উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করে কোম্পানিগুলো নির্বাচন করা হবে। বর্তমানে বিশেষ ক্ষমতা আইনে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ও দরপত্র আহ্বান ছাড়া একটি বিশেষ কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। কোম্পানিটির নাম ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশন।
জানা গেছে, কোম্পানিটি ইতোমধ্যে এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অস্বাভাবিক মূল্য নির্ধারণ করে সাড়ে চারশ কোটির বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে শেয়ার বাজার থেকে। আর এ উদ্যোগের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। নিজের পছন্দের কোম্পানিকে কাজ দিতে কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই বিশেষ আইনে ভোলার গ্যাস সিএনজি করার চুক্তি করা হয়।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরদিন ছাত্র-জনতা মিলে ভোলায় অবস্থিত ইন্ট্রাকোর রিফুয়েলিং স্টেশনটি বন্ধ করে দেয়। এখনো স্টেশনটি বন্ধ আছে। অন্যদিকে, এ খাতের ব্যবসায়ীরা চুক্তি বাতিল করে পুনরায় দরপত্রের মাধ্যমে কাজ দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বিএনএনিউজ২৪/ এমএইচ/হাসনা