বিএনএ,ঢাকা:যদিও ৫ই আগষ্টের আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং দলটির অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজি করতো। জুলাই গণ আন্দোলন পরবর্তী সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল—নতুন বাংলাদেশ হবে চাঁদামুক্ত। কিন্তু সেই প্রত্যাশায় গুড়ে বালি।
১৭ বছর আওয়ামী লীগের নির্যাতনের শিকার ও পালিয়ে থাকা বিএনপি ও দলটির অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ফিরে আসে। তাদের মধ্যে এমন ভাব জন্ম নেয়, আওয়ামী লীগবিহীন দেশের মালিক বিএনপি! ফলে নেতাকর্মীরা ক্ষমতায় আসীন হওয়ার আগেই টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। নিজেদের মধ্যে ফোনালাপে ওঠে আসে ‘১৭ বছর খাইনি, এখন খাব’।

সারাদেশে বিএনপি নেতাকর্মীরা এতটাই বেপরোয়া যে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকেও তারা চ্যালেঞ্জ করছে। গত ২রা জুলাই দিবাগত রাতে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার ঢাকা-বুড়িমারী মহাসড়কে, পণ্যবাহী গাড়ি থেকে চাঁদাবাজির কারণে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে, বেলাল ও সোহেল নামের দুই জনকে এক মাসের করে সাজা দেন। তাদের পাটগ্রাম থানায় রাখা হয়। রাতেই বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা থানায় হামলা ও ভাঙ্গচুর করে দুই চাঁদাবাজকে ছিনিয়ে নেয় এবং পুলিশকে অবরুদ্ধ করে রাখে।
পাটগ্রাম থানায় হামলা ও ভাঙচুরের খবর পেয়ে রাত সাড়ে ১১টার দিকে হাতীবান্ধা থানা থেকে তিন গাড়ি পুলিশ নিয়ে, রওনা হন সহকারী পুলিশ সুপার জয়ন্ত কুমার সেন ও হাতীবান্ধা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহমুদুন-নবী। কিন্তু তাঁরা থানার প্রধান ফটক পার হতে পারেননি। পুলিশ দলকে অবরুদ্ধ করে রাখে, বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ।
গত ৪ জুলাই জামায়াত ইসলামীর আমির ডা. শফিকুল ইসলাম বিএনপির নাম উল্লেখ না করে এই ঘটনার কড়া সমালোচনা করেছেন।
গত ৬ জুলাই রাত ১০ টারদিকে রাজধানীর মিরপুরের পশ্চিম মণিপুরে ছাত্রদল ও যুবদলের ১০–১৫ জনের একটি দল, সিরাজুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির বাসায় যায়। তিনি একসময় শ্রমিক লীগ করতেন। তাঁর বাসায় ঢুকে ছাত্রদল ও যুবদলের নেতারা বলেন, ‘তুই আওয়ামী লীগ করিস, আওয়ামী ফ্যাসিস্টের লোক, তোরে পুলিশ ধরাইয়া দেব, বাঁচতে হলে ২০ লাখ টাকা দে।’ এরপর চলতে থাকে তাঁদের ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদান, অন্যদিকে সিরাজুলের পরিবারের পক্ষ থেকে কাকুতি–মিনতি। রাত তিনটার সময় ওই বাসা থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে বের হন ছাত্রদল ও যুবদলের নেতা–কর্মীরা।
বাসায় ঢুকে চাঁদাবাজির খবর পেয়ে ওই সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় মিরপুর থানা–পুলিশের একটি দল। তারা এই চাঁদাবাজদের মধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার করে। চাঁদাবাজির ১৬ হাজার টাকা ও একটি মোটরসাইকেল তাঁদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়। বাকি টাকা নিয়ে পালিয়ে যান ওই দলে থাকা অন্যরা।
গত ৯ জুলাই ২ লাখ টাকা চাঁদা চেয়ে রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ভাংগারি পণ্যের ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে । হত্যার আগে ডেকে নিয়ে তাঁকে পিটিয়ে এবং ইট-পাথরের টুকরা দিয়ে আঘাত করে, মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ থেঁতলে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে তাঁকে বিবস্ত্র করা হয়। তাঁর শরীরের ওপর উঠে লাফাতে থাকে কেউ কেউ। হত্যাকারি ও হত্যার শিকার ব্যক্তি যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বলে জানা গেছে।
শুক্রবার ওই লোমহর্ষক ঘটনার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। একটি ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, নিথরভাবে পড়ে থাকা লাল চাঁদের শরীরের ওপর, কয়েকজন ব্যক্তিকে কংক্রিটের বড় খণ্ড দিয়ে আঘাত করে, তার মৃত্যু নিশ্চিত করে, আনন্দ–উল্লাস করছেন। এ ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।
শুক্রবার রাত থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠন ও রাজনৈতিক দল। বিএনপিও এই ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। নিহতের কন্যার দাবি— মামলায় প্রধান অভিযুক্ত তিনজনকে বাদ দিয়ে নিরীহ তিনজনকে তার পিতা সোহাগ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে।
এদিকে শনিবার এক সমাবেশে অনলাইনে যুক্ত হয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া— এই ঘটনায় সরকারের রহস্যজনক আচরণের তীব্র সমালোচনা করেছেন।
চাঁদা না দেওয়ায়’ পুরান ঢাকায় এক ভাঙারি ব্যবসায়ীকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে ক্ষোভ–বিক্ষোভের মধ্যে শুক্রবার বিকেল পাঁচটার দিকে রাজধানীর পল্লবীতে এ কে বিল্ডার্স নামের আবাসন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়। দুর্বৃত্তদের গুলিতে শরিফুল ইসলাম নামে প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। তাঁকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হামলাকারিরা ৫ কোটি টাকার চাঁদার দাবিতে এর আগেও প্রতিষ্ঠানটিতে হামলা চালিয়েছিল।
শুধু কী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান?—বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কবরস্থান দখল নিয়েও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। যদিও আজিমপুর কবরস্থানে চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের অভিযোগে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি লালবাগের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি আমিনুল ইসলাম আমিনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনায় বিব্রত—বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলকে কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই সংগঠনের নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। প্রশ্ন ওঠেছে, বিএনপি কী এখন চান্দাবাজ পার্টিতে পরিণত হয়েছে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, গত বছরের ৫ আগস্টের পর, সারাদেশে ‘মব’ সহিংসতার সঙ্গে জড়িতদের প্রশ্রয় দেয়া, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক চোখা নীতি, ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা থাকার পরও—সেনাবাহিনীর নিরবতা, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের অভাবের কারণে— দেশে ‘মব ও চাঁদাবাজি গানিতিক হারে বাড়ছে।
বিএনএ/সৈয়দ সাকিব