বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র একটি প্রামাণিক গ্রন্থ যা ১৯৭১ সালে এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সংগঠিত বিভিন্ন ঘটনার বিস্তারিত তথ্যভান্ডার হিসাবে স্বীকৃত। ১৫ খণ্ডে প্রকাশিত এ তথ্য ভাণ্ডারে এমন কিছু তথ্য রয়েছে যা সাধারণ মানুষের অজানা। বিশেষ করে এ প্রজন্ম জানেই না কত রক্ত, কত কষ্ট, নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ অর্জন ও উন্নয়নে বিশ্বের বিস্ময়। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে বাঙ্গালি জাতি বিলীন হয়ে যেত! এমনটাই মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস জানাতে বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ) ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে আসছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছে।
আজ প্রকাশিত হলো
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬১
২৭ জুন, ১৯৭১
একজন মায়ের কথা বলছি। হ্যাঁ, একজন বাঙালী মায়ের কথাই বলতে চাইছি। মার্চ মাসে ইয়াহিয়ার সরকার বন্দুক-রাইফেল জমা দেবার নির্দেশ দিয়েছেন। কেউ কেউ জমাও দিয়েছিল। কিন্তু যে মায়ের কথা বলছি, তিনি রুখে দাঁড়ালেন। তাঁর ছেলেদেরকে তিনি নির্দেশ দিলেন- খবরদার, বন্দুক জমা দিবি না। জল্লাদের হাতে বন্দুক দেয়ার অর্থ মৃত্যুকে ডেকে আনা। মা-বোনের ইজ্জত রক্ষা করবি না তোরা? বললেন তিনি। আমার মনে আছে, তিনি তাঁর তিন ছেলেকেই বললেন, মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করো। হয় ইয়াহিয়ার সেনাদেরকে খতম করবে আর না হয় মরবে। ছেলেরা কথা রেখেছে। তাঁর এক ছেলে শহীদ হয়েছে। আর বাকী দুজন এখনও লড়ছে। গেরিলা আক্রমণে তারা দুজনেই সকলের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পেয়েছে। এই কিছুক্ষণ আগে এদের দু’ ভাইয়ের সাথে আলাপ হয়েছে। বললাম- তোমার মায়ের কথা বলো। বললো মা আছেন গাঁয়ে। তিনি তাঁর কাজ করছেন। সবাইকে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবার জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন, প্রেরণা যোগাচ্ছেন। বললো- মা কি বলে জানেন আপনি? বলেন, মাকে আর দেশকে এক করে দেখবি। তোমরা আমার ছেলে নও, তোমরা বাংলাদেশের সন্তান- এই কথাটা মনে রেখো। মনে রেখো, ইয়াহিয়ার রক্তপিপাসু সেনারা আমার মতো বহু রক্তপ্রসবিনী মাতাকে হত্যা করেছে। আর এখন রক্তগর্ভা বাংলাদেশকে হত্যা করছে। কিন্তু ওরা জানে না, একজন মাকে হত্যা করা যায় কিন্তু দেশকে হত্যা করা যায় না। বাংলাদেশকে হত্যা করা যায় না। যাবেও না। মাতা আর পুত্রের রক্ত থেকে জন্ম নেবে রক্তবীজের ঝাড়।
এমনি মা আমরা পেয়েছি লক্ষ লক্ষ, আর এমনি পুত্রও পেয়েছি লক্ষ লক্ষ। শেখ মুজিবের বাংলাদেশ আজ মরণপণ লড়াইয়ে ব্যস্ত। সমস্ত শোষিত নিপীড়িত জনগণ আজ জেগে উঠেছে, হাতে তুলে নিয়েছে তারা তরবারি- আজ ভয় নেই। মুক্তিফৌজের বীর ভাইয়েরা প্রতিনিয়ত কঠিন আঘাত হানছে ইয়াহিয়ার সেনাদলের ওপর। আর ভয় নেই। মুক্তিফৌজের সামনে তিনটি কর্তব্য:
(এক) শত্রুকে চূড়ান্ত আক্রমণ করতে হবে।
(দুই) শত্রুর দালালদের খতম করতে হবে।
(তিন) কে শত্রু আর কে মিত্র তা চিনতে হবে।
আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করছি, আমরা জানি, পৃথিবীতে যে সমস্ত স্থানে মুক্তিযুদ্ধ চলছে তার মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন সর্বাপেক্ষা গৌরবময়। কারণগুলো কি? প্রথম কারণ: পৃথিবীর কোন মুক্তিযুদ্ধ এমন অভূতপূর্ব গণঐক্য দেখেনি। দ্বিতীয় কারণ : পৃথিবীর কোন মুক্তিযুদ্ধই যুদ্ধের শুরুতেই সশস্ত্র বাহিনীর এমন সমর্থন লাভ করেনি। স্মরণ করুন কিভাবে আমরা ই.পি.আর, ই.বি.আর পুলিশ, আনসার এবং মুজাহিদ ভাইদের সহযোগিতা পেয়েছি এবং এ মূহুর্তেও তারা কিভাবে জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করে যাচ্ছেন। এমনকি ভিয়েতনামের যুদ্ধেও প্রথমদিকে এ ধরনের সশস্ত্র সমর্থন পাওয়া যায়নি, কাজেই সবদিক থেকে বিচার বিবেচনা করে বলা যায় আমরা সবাই একটি গৌরবময় মহান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছি। মনে রাখতে হবে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কারণসমূহ যথার্থ। আমরা লড়াই করছি ন্যায়ের জন্য এবং আমাদের লড়াইও যথার্থ পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছে। কাজেই বিশ্বের সকল দেশ থেকে আমরা সমর্থন, সাহায্য ও সহানুভূতি পাবোই এবং পাচ্ছিও…..
(অধ্যাপক আব্দুল হাফিজ রচিত)
(তথ্যসুত্র:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র -৫ম খন্ড। পৃষ্ঠা নং ৯১) চলবে।
আগের পর্ব সমূহ :
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৬০
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৫৯
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৫৮
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৫৭
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৫৬
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৫৫
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৫৪
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৫৩
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৫২
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৫১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৫০
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র-পর্ব-৪৯
সম্পাদনা: এইচ চৌধুরী, গ্রন্থনায়: ইয়াসীন হীরা