24 C
আবহাওয়া
৮:৩৭ অপরাহ্ণ - নভেম্বর ১৭, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ: নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সামগ্রী উৎপাদন ও আমদানি নিষিদ্ধ করতে হবে

অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ: নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সামগ্রী উৎপাদন ও আমদানি নিষিদ্ধ করতে হবে

বিশেষ সম্পাদকীয় পড়ুন

।।মিজানুর রহমান মজুমদার।। বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে শিল্প বিপ্লব শুরু হয়েছে। গড়ে ওঠেছে হাজার হাজার শিল্প কারখানা। কিন্তু শিল্প কারখানা গুলো পরিকল্পিত নয়। নিয়ম-নীতি অমান্য করে যেন তেনভাবে এ সব শিল্প-কারখানা উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কিছু প্রতিষ্ঠান শিল্প কারখানা গুলোর দেখভাল–তদারকির দায়িত্ব থাকলেও প্রায় দেখা যায়, তারা যথাযথ দায়িত্ব পালন করেন না। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কোন সমন্বয় নেই।ফলে অহরহ শতশত শ্রমিকের প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে।

‘নেই’ এর সমাহার নিয়ে হাজির হন

যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তখন সরকারের তৎপরতা শুরু হয়। গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। এরপর আর কোনো অগ্রগতি হয় না। দুর্ঘটনা সংগঠিত হওয়ার পর বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীল সংস্থাকে তৎপর হতে দেখা যায়। বড় বড় কর্তারা গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীদের সামনে উপস্থিত হয়ে নানা অনিয়মের ফিরিস্থি তুলে ধরেন। কর্তারা অনেক ‘নেই’ এর সমাহার নিয়ে হাজির হন। ভবনের অনুমোদন নেই। নকশা অনুয়ায়ি ভবন তৈরী হয়নি। অগ্নি নির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা নেই, অগ্নি নির্বাপণের গাড়ি যাওয়ার রাস্তা নেই, জলাধার নেই, বিকল্প সিড়ি নেই, দাহ্য পর্দাথ রাখার আলাদা ব্যবস্থা নেই, সনদ নেই, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় ত্রুটি, ফ্লোরে ফ্লোরে তালা! খোলার লোকবল নেই।

নিমতলীতে রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকাণ্ড

২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকাণ্ডে কমপক্ষে ১১৮ জন মানুষ নিহত হয় এবং প্রায় শতাধিক মানুষ আহত হন। একটি ভবনে বিয়ের অনুষ্ঠান চলছিলো এবং এজন্য সেখানে ছিল অনেক অতিথির সমাগম। ভবনসংলগ্ন একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরিত হলে সেখান থেকে আশেপাশের ভবনগুলোতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও বেড়ে যায়। একটি ভবনে আগুন ধরে গেলেও মানুষ বের হতে পারেনি। শুধু পুরানা ঢাকার ঘুপড়ি অনুমোদনহীন রাসায়নিক গুদাম, কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে না। অনুমোদিত পোশাক পল্লী আশুলিয়া, সাভার, গাজীপুর টঙ্গী, রূপগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন শিল্প কারখানায়। প্রাণহানি হচ্ছে অহরহ। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। আগুন লাগার পর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গুলো সরব হয় কিন্তু কিছুদিন গেলেই তারা নীরব হয়ে যায়। যে কারণে থামানো যাচ্ছে না শ্রমিকের মৃত্যুর মিছিল। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকার আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় অবস্থিত তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড কারখানায় সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে ১১৭ জন পোশাক শ্রমিক নিহত হয়। ২০০ জনের অধিক আহত হয়। এটি দেশের ইতিহাসে কারখানায় সবচেয়ে মারাত্মক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা।বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটের কারণে আগুন লেগেছিল বলে ধারণা করা হয়, ভয়ানক এই দুর্ঘটনায় পোশাক কারখানার নয়তলা ভবনের ছয়তলা ভস্মীভূত হয়ে যায়।

রানা প্লাজা ধস

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে রানা প্লাজা নামের একটি বহুতল ভবন ধসে পড়ে। ভবনের কয়েকটি তলা নিচে দেবে যায়। কিছু অংশ পাশের একটি ভবনের ওপর পড়ে। এ দুর্ঘটনায় এক হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক নিহত এবং দুই হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয় যা বিশ্বের ইতিহাসে ৩য় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা। ভবনটিতে পোশাক কারখানা, একটি ব্যাংক এবং একাধিক অন্যান্য দোকান ছিল, সকালে ব্যস্ত সময়ে এই ধসের ঘটনাটি ঘটে। ভবনটিতে ফাটল থাকার কারণে ভবন না ব্যবহারের সতর্ক বার্তা থাকলেও তা উপেক্ষা করা হয়েছিল। ২০২১ সালের ৮জুলাই সবশেষ দুর্ঘটনাটি ঘটলো রূপগঞ্জে হাসেম ফুড লিমিটেড এর সেজান জুস কারখানায়। কারখানাটিতে ৫৩ জনের প্রাণহানি ঘটে। এর মধ্যে ৫০ জনই আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। এদের বেশিরভাগই শিশু (১৮ বছরের কম)। দোতালায় আগুন লাগায় কেউ নিচে নামতে পারেনি। চারতলার ছাদে যাওয়ার গেইট ও ফ্লোরে তালা লাগানো থাকায় কেউ ওপরে যেতে পারেনি। পুড়ে যাওয়া ৫০টি মরদেহ পাওয়া যায় একটি ফ্লোরে। প্রচুর রাসায়নিক থাকায় আগুন পুরো ভবনটিকে গ্রাস করে নেয়। ছিল না অগ্নি নির্বাপনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। হাসেম ফুড লিমিটেড এবং রাষ্ট্রীয় তদারককারি প্রতিষ্ঠানগুলো এর দায়ভার এড়াতে পারে না।

আগেও আগুন লেগেছিল
এরআগেও ২০১৮ সালের ২ মে রাত সাড়ে ১২ টায় রূপগঞ্জে হাসেম ফুড লিমিটেড কোম্পানির একটি ভবনে কুলসন সেমাই প্রসেসিং ইউনিটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। ফায়ার সার্ভিসের ৫ টি ৯ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুনে পুড়ে প্রায় ৯ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হলেও রাতে অগ্নিকাণ্ড সংগঠিত হলেও কেউ হতাহত হয়নি বলে মালিক পক্ষ দাবি করে ছিলেন। ওই সময়ে কারখানার ত্রুটি, অসংগতি গুলোর প্রতি মনযোগী হলে এমন ভয়াবহ প্রাণহানি এড়ানো যেত। কিছুদিন পর আবার কোথাও এমন ঘটনা পুনরায় ঘটবে না এমন কথা হলফ করে বলা যায় না।

১৫ হাজার গুদাম রয়েছে বাসাবাড়ির নিচতলায়
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুরান ঢাকার কে বি উর্দু রোড চকবাজার, লালবাগ, আরমানিটোলা, ইমামগঞ্জ, ইসলামবাগ, মিটফোর্ড, কোতোয়ালি ও হাজারীবাগে বাড়িতে বাড়িতে রাসায়নিকের গুদাম, রাবারের স্যান্ডেল ও প্লাস্টিকের কারখানা। লাখ লাখ মানুষ এমন ঝুঁকি নিয়েই বসবাস করছে। অধিকাংশ কারখানায় ও রাসায়নিক গুদামে প্রায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কারখানা ও রাসায়নিক গুদামগুলো ঢাকার কাছে টঙ্গী ও রাজধানীর শ্যামপুরের শিল্প এলাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। পরে এসব গুদাম স্থায়ীভাবে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে নিতে ৩১০ একর জমি বরাদ্দ করেছে সরকার। কিন্তু সেই কাজের অগ্রগতি নেই। গুদাম আর সরেনি। পুরান ঢাকায় রাসায়নিক গুদাম ও দাহ্য বস্তুর কারখানার সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার রয়েছে বাসাবাড়িতে। গুদামে রয়েছে গ্লিসারিন, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোস, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসেপ্রোইলসহ ভয়ংকর রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ।
সস্তায় নিম্নমানের  বৈদ্যুতিক তার ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ ব্যবহার

এসব রাসায়নিক সামান্য আগুনের স্পর্শ পেলেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে। শুধু শিল্প কারখানা নয়, দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলা পর্যায়ে আবাসিক-অনাবাসিক, শিল্প এলাকায় অগ্নিকাণ্ড সংগঠিত হয় সট-সার্কিট থেকে। এর অন্যতম কারণ বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় ত্রুটি। ভবন মালিকগণ ভবন নির্মাণকালে মানসম্মত বৈদ্যুতিক সামগ্রী ব্যবহার নিশ্চিত করেন না।ঠিকাদারগণ সস্তায় নিম্নমানের বৈদ্যুতিক তার ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে। ফলে এসব নিম্মমানের বৈদ্যুতিক তার ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ অগ্নিকাণ্ড থেকে সুরক্ষা দিতে পারছে না।

অগ্নিকাণ্ড ও ভবনধসে প্রাণহানি প্রতিরোধ সম্ভব যেভাবে

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অগ্নিকাণ্ড থেকে দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে হলে এখনই নিম্নমানের বৈদ্যুতিক তার ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ উৎপাদন, বিপণন, মজুদ এবং আমদানি নিষিদ্ধ করতে হবে। আর্ন্তজাতিক মান সম্মত নয়,এমন কোন বৈদ্যুতিক তার, যন্ত্রাংশ অথবা মেশিন আমদানি অনুমোদন দেয়া যাবে না। দাহ্য রাসায়নিক পদার্থ সংরক্ষণ করার জন্য আলাদা গুদাম রাখতে হবে। গুদামে পর্যাপ্ত কার্বন ডাই অক্সাইড মজুদ রাখার পাশাপাশি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকবল নিয়োগ দিতে হবে। শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যবস্থা সচল থাকাকালীন কোন ফ্লোরে তালা লাগানো যাবে না।শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যবস্থায় শিশু শ্রমকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে। ভবনের নকশা অনুমোদন, অন্যান্য সনদ প্রকাশ্য ঝুলিয়ে রাখতে হবে।তবেই অগ্নিকাণ্ড ও ভবনধসে প্রাণহানি প্রতিরোধ সম্ভব হবে।

Loading


শিরোনাম বিএনএ