বিএনএ ডেস্ক: ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বীর মুক্তিযোদ্ধা, গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র ও গণবিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় ঔষধ নীতির রূপকার। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের এক দিশারি মানুষ। গণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আমৃত্যু কাজ করে গেছেন তিনি।
সেখানেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, জাতীয় ও রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতেও ছিলেন সবসময় সরব। বার্ধক্য আর নানা শারীরিক জটিলতা নিয়েও জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছেন জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতে ভূমিকা রাখারা। জাতীয় ঔষধ নীতির প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তার উদ্যোগ, সমাজভিত্তিক জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির রূপরেখা হাজির করা তার দেশপ্রেমিক অবদানের একেকটি মাইলফলক।
কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন দীর্ঘ দিন ধরেই। নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হতো। এর মধ্যেই হানা দেয় বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন জটিলতা। রাজধানীর ধানমন্ডিতে নিজের গড়ে তোলা গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালেই ভর্তি হতে হয়। চিকিৎসকরা জানাচ্ছিলেন, তার রক্তে প্রদাহ ছড়িয়ে পড়েছে। নিতে হয়েছে লাইফ সাপোর্টে। শেষ পর্যন্ত সেই লাইফ সাপোর্ট থেকে আর ফিরিয়ে আনা যায়নি ৮১ বছর বয়সী ডা. জাফরুল্লাহকে। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে মঙ্গলবার রাত সোয়া ১১টায় না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি।
এক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী জাফরুল্লাহ চৌধুরী। মা-বাবার ১০ সন্তানের মধ্যে সবার বড় ছিলেন। জন্ম ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর, চট্টগ্রামের রাউজানে। তবে বেড়ে ওঠা ঢাকায়। বকশীবাজার স্কুল থেকে মাধ্যমিক আর ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ১৯৬৪ সালে সেখান থেকে পাস করে এফআরসিএস পড়তে চলে যান ইংল্যান্ডে। রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে জেনারেল ও ভাস্কুলার সার্জারিতে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষাতে উত্তীর্ণও হন। কিন্তু চূড়ান্ত পর্ব আর শেষ করা হয়নি তার। কারণ ততদিনে যুদ্ধের দামামা শুরু হয়েছে দেশে। তাই পড়ালেখা শেষ না করেই যুদ্ধে যোগ দিতে ফিরে আসেন দেশে।
যুদ্ধক্ষেত্রে তখন যুদ্ধাহতদের চিকিৎসার সংকট ছিল বড় সমস্যা। ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ ও ভারতের জিবি হাসপাতালের প্রধান সার্জন ডা. রথিন দত্তের সহযোগিতায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের প্রথম সাধারণ সম্পাদক ডা. এম এ মবিনকে নিয়ে আগরতলার বিশ্রামগঞ্জে জাফরুল্লাহ চৌধুরী গড়ে তোলেন প্রথম ফিল্ড হাসপাতাল ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’। এর কমান্ডিং অফিসার ছিলেন ডা. সিতারা বেগম বীরপ্রতীক। প্রশিক্ষিত নার্স না থাকায় নারী স্বেচ্ছাসেবীদের প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দেন ডা. জাফরুল্লাহ। সে হাসপাতালের দুই স্বেচ্ছাসেবী ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল ও তার বোন সাঈদা কামাল। ৪৮০ শয্যার এই ফিল্ড হাসপাতাল মুক্তিযুদ্ধের সময় অসংখ্য মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে দেশের সাধারণ মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার সংগ্রাম শুরু করেন জাফরুল্লাহ। যুদ্ধকালীন ফিল্ড হাসপাতালটি প্রথমে কুমিল্লায় ও পরে রাজধানীর সাভারে স্থানান্তর করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরামর্শে তার নাম দেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। এখানেই প্রাইমারি কেয়ার কনসেপ্ট পাইলট প্রকল্প আকারে বাস্তবায়ন করেন তিনি। তারই ভিত্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘ আলমাআতা কনফারেন্সের মাধ্যমে বৈশ্বিক সার্বজনীন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্পের ঘোষণা দেয়। মিনি ল্যাপারোটমির মাধ্যমে লাইগেশন সার্জারির উদ্ভাবনও করেছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বিশ্বখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটে প্রকাশিত হয় তার এ সংক্রান্ত গবেষণা প্রবন্ধ। বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত সব জার্নালে তার এমন স্বাস্ব্যবিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধেন সংখ্যা অসংখ্য।
দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে সরকার ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে ডা. জাফরুল্লাহকে। ১৯৮৫ সালে ফিলিপাইন থেকে পেয়েছেন রামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার, ১৯৯২ সালে সুইডেন থেকে পেয়েছেন বিকল্প নোবেলখ্যাত রাইট লাভলিহুড পুরস্কার।
বিএনএনিউজ২৪/ এমএইচ