।।সিরাজুল আরেফীন চৌধুরী।।
মহান আল্লাহ বলেন- “কুল বি ফাদ লিল্লাহি ওয়া বি রাহমাতিহি ফাবিজালিকা ফালইয়াফরাহু, হুয়া খাইরুম মিম্মা ইয়া ইয়াজমাউন- অর্থাৎ হে হাবিব আপনি বলে দিন তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া লাভ করলে সেটার উপর খুশি উদযাপন কর;(এটি) তাহারা যা জমা করে তা অপেক্ষা উত্তম।” সূরা ইউনুস, আয়াত ৫৮।
এখানে আল্লাহ বলেছেন আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া লাভ করলে আমরা যেন খুশি উদযাপন করি। প্রশ্ন হল কোনটি আল্লাহর অনুগ্রহ নয়? সবকিছুইতো আল্লাহ দিয়েছেন। আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন সুন্দরভাবে, আমাদের জন্য পৃথিবীটাকে সাজিয়েছেন, আকাশকে সাজিয়েছেন তারকা দিয়ে, বিশ্রামের জন্য রাত্রি দিয়েছেন, জমিনে উত্তম রিজিকের ব্যবস্থা করেছেন, বিশ্ব-বৈচিত্রের সৌন্দর্য দেখার জন্য চোখ দিয়েছেন, শোনার জন্য কান দিয়েছেন, চলাফেরা-কাজকর্মের জন্য হাত-পা দিয়েছেন ইত্যাদি।
এভাবে বলতে গেলে আল্লাহর নিয়ামত গুনে শেষ করা যাবে না। এজন্য আল্লাহ বলেন -তোমরা আমার কোন কোন নিয়ামত অস্বীকার করবে?
(সূরা আর-রহমান) অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন-“ওয়াইন তা উদ্দু নিমাতাল্লাহে লা তুহছুহা অর্থাৎ তোমরা আমার নেয়ামত গুনে শেষ করতে পারবে না” (সূরা নাহল,আয়াত ১৮)।
এত নিয়ামতের মধ্যে একটি বিশেষ নেয়ামতকে নির্দিষ্ট করে মহান আল্লাহ বিশেষ অনুগ্রহ বা নিয়ামত বলে ঘোষণা করেন। সেটা কি? পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন- “লাকাদ মান্নল্লাহু আলাল মু’মিনিনা ইজ বা আছা ফিহিম রাসুলা” অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহর মহান অনুগ্রহ হচ্ছে মুমিনদের উপর, যে তাদের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসুল প্রেরণ করেছেন (সুরা আল ইমরান আয়াত ১৬৪)।
মহান আল্লাহ আমাদের অসংখ্য নিয়ামত দিয়েছেন অথচ এত নিমাত বা অনুগ্রহের মধ্যে অন্য কোন নেয়ামতের ব্যাপারে এভাবে বিশেষভাবে উল্লেখ করেননি। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় মহান আল্লাহ আমাদের যত নেয়ামত দিয়েছেন সকল নেয়ামতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নিয়ামত হল মানবতার মুক্তির দূত, রাহমাতাল্লিল আলামিন, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল(দ.) কে আমাদের নিকট প্রেরণ করা।
আমাদের আলোচিত পূর্ববর্তী আয়াত-এ (সূরা ইউনুস আয়াত ৫৮)- আল্লাহ আমাদের নিয়ামত প্রাপ্তিতে খুশি উদযাপন করার জন্য বলেছেন। আর এখানে (সূরা আল ইমরান আয়াত১৬৪)-এ সকল নেয়ামতের মধ্যে সেরা নিয়ামত হিসেবে উল্লেখ করেছেন আমাদের নিকট মানবতার মুক্তির দূত, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল (দ.)কে প্রেরণ করা। এই নিয়ামত প্রাপ্তিতে আমরা কি করব? এখানে আল্লাহ আমাদেরকে এই নেয়ামত প্রাপ্তিকে খুশী উদযাপন করতে বলেছেন। এখানেই শেষ নয়।
এই খুশি উদযাপনকে আল্লাহ বলেন-হুয়া খাইরুম মিম্মা ইয়া ইয়াজমাউন: এটা আমাদের জমাকৃত সকল নেক কাজের মধ্যে উত্তম। আর আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী এই খুশি উদযাপন-ই হল ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) উদযাপন। ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ, ঈদে মিলাদুন্নবী মানে রাসুলের (দ.) আগমনে আনন্দ উদযাপন করা। পবিত্র কুরআনুল করিমের এরকম আরও অসংখ্য আয়াতের মাধ্যমে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের স্বপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়।
এই খুশি উদযাপন মূলত আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। এটিকে অস্বীকার করা মানে আল্লাহর নিয়ামতকে অস্বীকার করা। সাধারণত কারো উপহার পেয়ে আমরা খুশি হলে উপহারদাতা সন্তুষ্ট হন আর অখুশি হলে উপহার দাতা কষ্ট পান।
আর এখানে উপহার দাতা হলেন স্বয়ং সৃষ্টি জগতের মালিক মহান আল্লাহ, আমাদের প্রভু, প্রতিপালক। আর মহান আল্লাহ যা দিয়েছেন বা যাকে প্রেরণ করেছেন তা হল সৃষ্টি জগতের শিরোমণি, সকল সৃষ্টির সেরা সৃষ্টি আল্লাহর প্রিয় হাবিব ও রাসুল। তাহলে আমরা যারা এ নিয়ামত পেয়েছি, রাসূলকে আমাদের নিকট পেয়েছি বিষয়টি আমাদের নিকট কেমন আনন্দের, আমাদের কেমন শুকরিয়া আদায় করা উচিত?
প্রশ্ন আসতে পারে এই আনন্দ আমরা কিভাবে উদযাপন করব? সহজ উত্তর হল-অবশ্যই শরীয়ত সম্মতভাবে। আনন্দ যে কোনভাবেই উদযাপন করা যায় তবে সেটা যেন ইসলামী শরীয়ত বিরোধী কোনো কাজের মাধ্যমে না হয়। বর্তমান বিশ্বে জশনে জুলুস পালন করা হয়। জশন মানে আনন্দ, জুলুস মানে মিছিল অর্থাৎ আনন্দ মিছিল; এর মাধ্যমে হাজার, লক্ষ মানুষ একত্রিত হয়ে কোরআন তেলাওয়াত, হামদ-নাত, জিকির, দরুদ-সালাম ইত্যাদির মাধ্যমে নবীর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা হয়। এভাবে ঈদে মিলাদুন্নবীকে (দ.)-কে কেন্দ্র করে লক্ষ লক্ষ মানুষের একত্রিত হওয়া- এটা মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের ইঙ্গিত বহন করে।
এটি ইসলামের শত্রুদের বিশেষ করে ইহুদিবাদী চক্রের জন্য বিরাট আতঙ্কের বিষয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিন দিন ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) উদযাপনে মানুষের স্বত:স্ফুর্ত অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ আল্লাহর হাবীবের মান-মর্যাদা আল্লাহ নিজেই বৃদ্ধি করেন। এ কারণে রাসূলের নাম রেখেছেন মোহাম্মদ অর্থাৎ প্রশংসিত। ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন মূলত রাসূল (দ.) এর প্রতি আন্তরিক মহব্বতের নিদর্শন, মহব্বতের বহিঃপ্রকাশ। এর মাধ্যমে বর্তমান বিশ্বে ইসলামের শান-শওকত প্রকাশিত হচ্ছে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক (দর্শন), বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা)