সাবেক প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান পদত্যাগ করার আগে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে ‘জুডিশিয়াল ক্যু’ করার চেষ্টা করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ১০ আগস্ট রাতে এ তথ্য জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ। সেখানে পোস্টটি করেন সহসমন্বয়ক মুসাদ্দিক আলী ইবনে মুহাম্মদ। ‘ষড়যন্ত্র ফাঁস’ শিরোনামে তিনি তার টাইমলাইনে যা লিখেছেন তাতে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের পদত্যাগের নেপথ্যে কঠিন ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেছে। শেখ হাসিনাকে এক্স প্রধান বিচারপতি সিনহা যেভাবে অবৈধ ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন, ঠিক তেমনি ষড়যন্ত্র করেছিল ওবায়দুল হাসানসহ কয়েকজন।
এতে সহসমন্বয়ক মুসাদ্দিক আলী ইবনে মুহাম্মদ অভিযোগ করেন, সজীব ওয়াজেদ জয় এতদিন আপনাদের সাথে ‘আমি নাই, মা নাই’ বলে বলে হঠাৎ শনিবার রয়টার্সকে বলেছেন তার মা পদত্যাগ করেননি। এটি একটি পরিকল্পিত ঘোষণা ছিল যা বোঝা গেছে আজ।
সেনাবাহিনীর নিচের দিকের অফিসাররা যদি জনগণের পক্ষে না থাকত, তাহলে আজকে আরেকটা রক্তের বন্যা বয়ে যেত। আজকেও সেনাবাহিনীর ছোট অফিসাররা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থেকে ছাত্র জনতাকে বাঁচিয়েছে।
আজকে একটা ক্যুয়ের প্ল্যান করেছিল জয় এবং আরাফাত। কিন্তু সঠিক সময়ে সেনাবাহিনীর গোয়েন্দারা ছাত্রদের কাছে তথ্য ফাঁস করে দেয়। এই তথ্য জানার পরে জুডিশিয়াল ক্যু রুখে দেয় ছাত্ররা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপে দেওয়া পোস্টে বলা হয়, জয় আরাফাত আর তাদের গাইডদের গোপন প্ল্যান ছিল এইরকম, ড. মোহাম্মদ ইউনুস যখন রংপুরে আবু সাঈদের বাড়ি পরিদর্শন ও কবর জিয়ারতের জন্য যাবেন এবং উনার হেলিকপ্টার যখন আকাশে থাকবে, ঠিক সেই সময়ে হাইকোর্টের অ্যাপিলিয়েড ডিভিশনের বিচারপতিরা ফুল কোর্ট বসিয়ে এই অন্তর্বর্তী সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করবেন।
সাথে সাথে এই ক্যুয়ের সংগে জড়িত সেনাবাহিনীর ২৫ কর্মকর্তা, চাকরি থেকে কর্মবিরতিতে থাকা দুর্নীতিবাজ পুলিশের একটি দল রাজধানীতে হট্টগোল শুরু করবে আর শেখ হাসিনা ভারত থেকে বাংলাদেশে চলে আসবেন এবং আওয়ামী লীগের আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরা মাঠে চলে আসবেন।
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রধান বিচারপতি সরকারের সাথে কোনো আলোচনা না করে হঠাৎ ৫৭ বিচারপতিকে জরুরি মিটিংয়ে ডাকেন। স্ক্রলে জরুরি মিটিং ডাকার সংবাদ দেখে দর্শকরাও কনফিউজড হন। কিন্তু আগে থেকে গোপন খবর পাওয়া ছাত্র জনতা সকাল ৯টার আগেই চতুর্দিক থেকে ছুটে এসে হাইকোর্ট ঘেরাও করে। সেনাবাহিনীর সমর্থনে প্রধান বিচারপতি পিছু হটতে বাধ্য হন এবং পালিয়ে থাকেন। মিটিং স্থগিত হয়। ছাত্ররা বিচারপতির বাসা ঘেরাও করে রাখে। সেনাবাহিনী শৃংখলা রক্ষার আবরণে সেখানে ছিল। পদত্যাগপত্র সরকারকে দেওয়া হয়েছে নিশ্চিত হয়ে ছাত্ররা হাইকোর্ট এবং বাসভবন ত্যাগ করেন বলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপে উল্লেখ করা হয়।
এ দিকে, ১০ ই আগষ্ট রাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় তার এক্স হ্যান্ডেলে লিখেন, বিক্ষোভকারীরা সুপ্রিম কোর্টে হামলা এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। তারা আদালতের পদত্যাগ দাবি করে এবং তারা নিয়োগের জন্য লোকদের নামের তালিকা সরবরাহ করে। অন্তর্বর্তী সরকার তাদের দাবি মেনে নেয় এবং বিক্ষোভকারীদের দেওয়া নামে বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। একটি দেশের সর্বোচ্চ আদালত কীভাবে কোনো যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়া, নির্বাচিত সংসদ ছাড়া পরিবর্তন করা যায়? এটা সংস্কার নয়, এটি গণঅরাজকতা। বাংলাদেশে কোন আইনশৃঙ্খলা নেই যখন এমনকি সুপ্রিম কোর্টও নিরাপদ নয়।
প্রসঙ্গত, প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের ৬ বিচারপতির পদত্যাগের দাবিতে শনিবার সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বর্ধিত ভবনের সামনে সাড়ে তিন ঘণ্টা বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। বিক্ষোভের মুখে দুপুর আড়াইটার দিকে প্রধান বিচারপতি মো. ওবায়দুল হাসান পদত্যাগ করেন। একই সঙ্গে পদত্যাগ করেন আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি এম এনায়েতুর রহিম, মো. আবু জাফর সিদ্দিকী, জাহাঙ্গীর হোসেন, মো. শাহিনুর ইসলাম ও কাশেফা হোসেন।
এরপরই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবি অনুয়ায়িদেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে নিয়োগ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। এ বিষয়ে শনিবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে আইন মন্ত্রণালয়। রোববার দুপুরে বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ করেন প্রধান বিচারপতি।
সৈয়দ রেফাত আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে অনার্স এ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে এমএ পাস করার পর যুক্তরাষ্ট্রের টাফ্ট ইউনিভার্সিটির ফ্লেচার স্কুল অব ল এন্ড ডিপ্লোমেসি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৩ সালের ২৭ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়ে ২০০৫ সালে স্থায়ী হন তিনি।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের জন্ম ১৯৫৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর। তিনি বাংলাদেশের প্রথিতযশা সিনিয়র আইনজীবী ও সাবেক অ্যাটর্নী জেনারেল ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদ ও ড. সুফিয়া আহমেদের ছেলে। ভাষা সৈনিক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত ড. সুফিয়া আহমেদ বাংলাদেশের প্রথম নারী জাতীয় অধ্যাপক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের চেয়ারম্যানেরও দায়িত্ব পালন করেছেন নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতির মা।
নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতির পিতা ইশতিয়াক আহমেদ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। ২০০১ সালে তিনি দ্বিতীয়বার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।
বিএনএ নিউজ/শামীমা চৌধুরী শাম্মী /এইচমুন্নী