বিএনএ, বিশ্বডেস্ক : টে ইয়ং হো ছিলেন লন্ডনে উত্তর কোরিয়া সরকারের উপ রাষ্ট্রদূত। ২০১৬ সালে তিনি পক্ষ ত্যাগ করেন। তিনি বলছেন কীভাবে জীবন বাজি রেখে তিনি পালিয়ে যান এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় নতুন জীবন শুরু করেন।
দক্ষিণ কোরিয়ায় যাওয়ার পর তিনি সেখানে ২০২০ সালের সংসদ নির্বাচনেও বিজয়ী হন।
নিজের এবং সন্তানদের জন্য একটি মুক্ত ও উন্নত জীবনের আশায় তার উত্তর কোরিয়া ত্যাগের কাহিনী সম্পর্কে তিনি নিজেই যা বলেছেন।
আমি একটি মুক্ত জীবনের পথ বেছে নিয়েছিলাম, কিন্তু তার জন্য আমাকে জীবনের চরম ঝুঁকি নিতে হয়েছিল। এখানে আপনাদের শোনাবো সেই কাহিনী – যে কাহিনী আশার সঞ্চার করবে।
আমি যে পরিবারে জন্মেছি, সেখানে আমার বাবা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক আর মা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। আমার পরিবারে আরও ছিল এক বড় ভাই ও এক ছোট বোন।
আমার বয়স যখন ১২ বছর আমার মা আমাকে পাঠালেন পিয়ংইয়াংয়ের বিদেশি ভাষা শিক্ষার স্কুলে। আমি হতে চেয়েছিলাম মহাকাশচারী। কিন্তু সেটা ছিল খুব কঠিন।
মা বললেন, কূটনীতিকরা সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়াতে পারে, তারা বিমানেও ভ্রমণ করতে পারে। তার এই কথায় আমার মত বদলে গেল।
সেই মুহূর্তটিতে আমি বুঝতে পারলাম সমাজে সুবিধাভোগী বলতে কী বোঝায়।
উত্তর কোরিয়ার সমাজ তিন ভাগে বিভক্ত।
আপনি সমাজের কোন শ্রেণির অংশ উত্তর কোরিয়ায় এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর ওপরই নির্ভর করবে আপনি কোথায় থাকবেন, কী ধরনের শিক্ষা আপনি পাবেন এবং কোন ধরনের চাকরি আপনি করবেন।
আমি সমাজের যে অংশে জন্মেছি, উত্তর কোরিয়ার জনসংখ্যার মাত্র ২০ শতাংশ তার অংশ।
আপনি যদি শাসক শ্রেণির অংশ হন তাহলে আপনি পিয়ংইয়াংয়ে বাস করবেন। এই শহরে রয়েছে নানা সুযোগ সুবিধা- ভাল স্কুল, মেট্রো ব্যবস্থা, দামী দামী সব দোকান, আরও নানা কিছু।
কিন্তু আপনার জন্ম যদি হয় দরিদ্র শ্রেণিতে, তাহলে আপনার জীবন কাটবে কয়লা খনির আশেপাশে অথবা নির্জন গ্রামে। জীবন যাপনের জন্য তাদের প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করতে হয়।
উত্তর কোরিয়ায় রয়েছে ২১ শতকের একটি দাসপ্রথা ব্যবস্থা। কারণ আপনি স্বাধীনভাবে কোথাও ঘোরাফেরা করতে পারবেন না।
আমি এবং আমার পরিবারসহ উত্তর কোরিয়ার সব মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে যে শাসক কিম পরিবার হচ্ছে ভগবান। তারাই জাতির রক্ষাকর্তা।
কিম পরিবারের সদস্যরা বংশ পরম্পরায় এই ক্ষমতা ভোগ করছে। দেশের নেতৃত্বের হাতবদল ঘটছে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। দেশের যা কিছু সম্পদ রয়েছে তার সবই এই কিম পরিবার কুক্ষিগত করে আছে।
উত্তর কোরিয়ানদের ছোটবেলা থেকেই মগজ ধোলাই করা হয় এবং শেখানো হয় যে কিম পরিবারের কাউকে দেখলেই প্রচণ্ড আবেগে তাদের কেঁদে ফেলতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে তাদের এই শিক্ষা দেয়া হয়।
আমি যখন ১৯৮৮ সালে উত্তর কোরিয়ার কূটনৈতিক বিভাগে যোগদান করি, সেটা ছিল খুবই এক গোলযোগের বছর।
সে বছর দক্ষিণ কোরিয়ায় সোল অলিম্পিকস এবং তার পরের বছর বার্লিন ওয়ালের পতনের ঘটনা নিয়ে উত্তর কোরিয়ার সরকার ছিল বেশ বিচলিত।
উনিশশো একানব্বই সালে পিয়ংইয়াং সরকারের দীর্ঘদিনের মিত্র দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটেছিল।
হঠাৎ করেই দেখা গেল উত্তর কোরিয়া তার প্রধান বাণিজ্য সঙ্গীকে হারিয়েছে। এনিয়ে তিন-চার বছর ধরে খুব গণ্ডগোল চলছিল
কূটনীতিক হিসেবে আমার প্রথম পোস্টিং ছিল ডেনমার্কে। সেটা ১৯৯৬ সালের ঘটনা। আমার বয়স তখন ৩৪ বছর।
মনে পড়ে, প্রথম যখন কোপেনহেগেন শহর পা রাখলাম তখন সেখানে কোন ভিক্ষুক নেই দেখে খুবই অবাক হয়েছিলাম। উত্তর কোরিয়ায় আমাদের যেসব উপন্যাস পড়ানো হতো তার সবই ছিল চার্লস ডিকেন্সের অলিভার টুইস্টের মতো, যেখানে ১৯২০ বা ১৯৩০ সালে পশ্চিমা দুনিয়ার দারিদ্রকে ফুটিয়ে তোলা হতো।
কিন্তু না, কোপেনহেগেন দেখতে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে সবার ছিল সমান অধিকার, সবার জন্য ছিল বিনামূল্যে শিক্ষা। চিকিৎসাও ছিল ফ্রি।
আমার আয় থেকে যা কিছু জমাতে পারতাম তার সবটাই আমি উত্তর কোরিয়ায় আমার বাবা-মা এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজনকে পাঠিয়ে দিতাম। কারণ তখন সেখানে দুর্ভিক্ষ চলছিল।
কিম জং আন বলে যে কেউ আছে সেটা ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার শাসক-চক্রের মধ্যে অনেকেই জানতো না।
কিম জং ইল-এর ছেলে কি এবার শাসনক্ষমতা গ্রহণ করবে? এর মানে কী আমরা আরও ৪০ থেকে ৫০ বছর কিম পরিবারের আরেকজনের শাসন দেখতে পাবো? সেরকম কিছু ঘটলে আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ তাহলে কী হবে?
লন্ডন থেকে পালিয়ে যাওয়া
লন্ডনে যখন আমি দ্বিতীয়বার চাকরি নিয়ে গিয়েছিলাম তখন থেকেই আমার মনে একটা হতাশা এসে বাসা বাঁধতে শুরু করে। লন্ডনে আমি প্রথম দায়িত্ব পালন করেছি ২০০৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত। এসময় আমার প্রধান কাজ ছিল উত্তর কোরিয়ার সরকার এবং এর নেতা কিম জং আন-এর ঢাকঢোল বাজানো।
উত্তর কোরিয়ার পক্ষে আমি যদিও অনেক কাজ করেছি, মানুষের সামনে হাসি মুখে কথা বলেছি, কিন্তু আমার মনের গভীরে ব্যাপারটা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত।
দু’হাজার ষোল সালের মার্চ মাসে এক ঘটনা নিয়ে উত্তর কোরিয়ায় সবাই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল।
উত্তর কোরিয়ার ১২/১৩ জন কিশোরী একসাথে দেশত্যাগ করে দক্ষিণ কোরিয়ায় চলে যায়।
তখন উত্তর কোরিয়ার সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে সব কূটনীতিকদের সন্তান, যাদের বয়স ২৫ বছরের ওপরে, তাদের যত দ্রুত সম্ভব দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। সে সময় আমার বড় ছেলের বয়স ছিল ২৫।
আমি ভাবলাম: বাবা হিসেবে ছেলের প্রতি আমার কর্তব্য কী? প্রথমত: মানুষ হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মুক্ত জীবনযাপন করা। সুতরাং, আমার কাছ থেকে তার উত্তরাধিকার হবে মুক্তি। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমার ছেলে স্বাধীন পরিবেশে বড় হবে।
লন্ডনে লোকজন পাব বা পানশালায় বসে ফুটবল ম্যাচ দেখে। একদিন আমি আমার বসকে বললাম, “মি. অ্যাম্বাসেডর, এই ম্যাচটি আমি এক পাবে বসে দেখতে চাই। আমার পরিবারও আমার সাথে থাকবে।”
এম্বেসি থেকে বেরিয়েই আমার দৌড়ুতে শুরু করলাম। কিন্তু ১০০ মিটারের মতো যাওয়ার পর আমার হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম। কেন দাঁড়ালাম জানি না। ঘুরে দেখি দূর থেকে এম্বেসি ভবন দেখা যাচ্ছে।
সে সময় আমার চিন্তা ছিল: দেশের পক্ষ ত্যাগ করা কি ঠিক হচ্ছে? উত্তর কোরিয়া আমার যেসব আত্মীয়স্বজন রয়েছে এরপর তাদের কী হবে?
আমার চোখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগলো। মনে পড়ে গেল দেশ আর পতাকার জন্য আমাকে কত কিছুই না করতে হয়েছে।
একটু ভেবে আমি বললাম, “না, চলো যাওয়া যাক। সুযোগটা হাতছাড়া করা যাবে না।” এরপর আমরা আবার দৌড়ুতে শুরু করলাম। এবং গায়েব হয়ে গেলাম।
এখন দক্ষিণ কোরিয়াতে যতদিন থাকছি, মনে হচ্ছে এই স্বাধীনতার স্বাদটি পুরোপুরি উপভোগ করছি। আমার মনে হয় উত্তর কোরিয়ায় আমার পরিবার এবং জনগণও যাতে এই মুক্তির স্বাদ পায় তার জন্য আরও কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।
দক্ষিণ কোরিয়া এখন উত্তর কোরিয়ার সাথে শান্তি স্থাপনের জন্য সম্পূর্ণভাবে তৈরি। আমার মনে হয় শান্তিপূর্ণ পথে দুটি দেশ আপোষ করতে পারবে এবং আবার এক হতে পারবে। শান্তিই হচ্ছে এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বিএনএনিউজ/এইচ.এম।