বিএনএ ব্রাহ্মণবাড়িয়া : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড (এপিএসসিএল)’র একজন ক্ষিতিশ চন্দ্র বিশ্বাসের প্রভাবের কথা যেন ওপেন সিক্রেট। কোম্পানির একজন নির্বাহী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ) হয়েও অদৃশ্য খুঁটির জোরে সর্বক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চেয়েও বেশী প্রভাব বিস্তার করে থাকেন তিনি।
নিজের পদোন্নতি ছাড়াও কোম্পানির বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদোন্নতি ও বদলিসহ সবকিছুই তার ইশারায় হচ্ছে।
বিদ্যুৎ নতুন প্লান্টের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ইতোমধ্যেই ক্ষিতিশ চন্দ্র বিশ্বাস বিশাল অর্থ বৈভবের মালিক হয়ে গেছেন। দ্বিতীয় দফায় চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর মতলবে নতুন আরও একটি বিদ্যুৎ প্লান্ট নির্মাণ প্রকল্পের কাজ ইচ্ছাকৃত গড়িমসি করে বিলম্ব করছেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে।খোদ কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে তার ব্যাপারে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, একাধিক কর্মকর্তা জানান, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড (এপিএসসিএল)’র প্রশাসনিক প্রধান ব্যবস্থাপনা পরিচালক হলেও, তার কোনো সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত নির্বাহী পরিচালক ক্ষিতিশ চন্দ্র বিশ্বাস অনুমতি না দেন। তাই তার উত্থান এপিএসসিএল’র সীমানা পেরিয়ে এখন আশুগঞ্জের মানুষের মুখে মুখে।
বিশ্বস্থ সূত্র দাবি করেছে, ক্ষিতিশ চন্দ্রের বর্তমানে ঢাকার বসুন্ধরায় ১টি, শ্যামলিতে ১টি ফ্ল্যাট এবং পূর্বাঞ্চলে ১২ কাঠার ১ টি প্লট ও ভারতের কলকাতায় ১টি বাড়ি রয়েছে। এক্সিম ব্যাংক, এবি ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকে ক্ষিতিশ চন্দ্র ও তার স্ত্রীর নামে কয়েক কোটি টাকার ফিক্সড ডিপোজিট রয়েছে।
পরিচালক ক্ষিতীশ চন্দ্র বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে সেগুলো হলো, কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদোন্নতি ও বদলিসহ সবকিছুতেই প্রভাব বিস্তার। চুক্তি উপেক্ষা করে চীন এবং ভারতের তৈরি নিম্নমানের যন্ত্রপাতিতে প্লান্ট নির্মাণ। প্রকল্প পরিচালকের চাকরির মেয়াদ বাড়াতে প্ল্যান্টের কাজ সম্পন্ন করতে বিলম্ব। বিনা দরপত্রে স্ক্রাপ মালামাল বিক্রি করে কোটি টাকা আত্মসাৎ।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৮৮ সালে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে এপিএসসিএলে চাকরিতে যোগাদান করেন ক্ষিতিশ চন্দ্র বিশ্বাস। ২০১২ সালে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের টারবাইন বিভাগের ব্যবস্থাপক নিযুক্ত হন তিনি। এরপর ২০১২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৭ বছরে নির্বাহী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ) পদে পদোন্নতি লাভ করেন ক্ষিতিশ চন্দ্র।
সে সময় তার আগে চাকরিতে যোগদান করা প্রকৌশলী আব্দুস সামাদকে বাদ দিয়ে ক্ষিতিশ চন্দ্রকে নির্বাহী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ) পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। পরে ২০১৯ সালে আব্দুস সামাদ এপিএসসিএল থেকে চাকরি ছেড়ে নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানিতে যোগ দেন।
এরমধ্যে গত ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে আশুগঞ্জ ৪৫০ মেঘাওয়াট (নর্থ) প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন ক্ষিতিশ চন্দ্র। এ প্রকল্পটির কাজ শেষ হবার পর, আশগঞ্জ ৪০০ মেগাওয়াট সিসিপিপি (ইস্ট) প্রস্তাবিত নতুন প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে তাকে দায়িত্ব দেয়ার জন্য তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক আনোয়ার হোসেনকে তার অধিনস্থ করে তত্তাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে পদায়ন করা হয়।
এদিকে, এপিএসসিএল’র পূর্ববর্তী ২ জন পরিচালক (প্রজেক্ট এন্ড প্ল্যানিং) জয়নাল আবেদিন খান ও অজিত কুমার সরকার ৬০ বছর বয়সে চাকরি থেকে অবসর নিলেও ক্ষিতিশ চন্দ্রের চাকরির সুবিধার্থে ২০১৯ সালে বয়সসীমা বাড়িয়ে ৬২ বছর করা হয়। যা আগামি ২০২২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ণ হবে। কিন্তু এরই মধ্যে চাকরিতে টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন মহলে তদবীর শুরু করেছেন তিনি। চাকরির সময়সীমা ৬২ বছর থেকে বাড়িয়ে ৬৪ বছর করে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাড়াতে ক্ষিতিশ চন্দ্র আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপনের জন্য উপর মহল থেকে জোর তদবির চালাচ্ছেন বলে একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
উল্লেখ্য যে, গত ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে কয়েকটি নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করার পরিকল্পনা করে এপিএসসিএল। যার মধ্যে একটি ‘আশুগঞ্জ ৪৫০ মেগাওয়াট সিসিপিপি (নর্থ) প্ল্যান্টের প্রকল্প’। এর প্রকল্প পরিচালক ছিলেন ক্ষিতিশ চন্দ্র বিশ্বাস।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৪৫০ মেগাওয়াটের উক্ত প্ল্যান্টটি উৎপাদনে আসার পর থেকে কখনও ৩৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের বেশি জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করতে পারেনি। কিন্তু একই সময়ে আশুগঞ্জ ৪৫০ মেগাওয়াট সিসিপিপি (সাউথ) নামে আরেকটি প্ল্যান্ট স্থাপিত হয়। যার প্রকল্প পরিচালক ছিলেন আবদুস সামাদ নামে একজন কর্মকর্তা। সাউথ প্ল্যানটি চালু হবার পর থেকে জাতীয় গ্রিডে ৪৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছে। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক হিসেবে ক্ষিতিশ চন্দ্র বিশ্বাসের দায়িত্ব পালন করা নর্থ প্ল্যানটি ৩৮০ মেঘাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারায় সঙ্গত কারণেই এর মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে অনেকে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একাধিক প্রকৌশলী জানান, ৪৫০ মেগাওয়াট সাউথ প্ল্যান্টের স্পেয়ার পার্টস জি-৭ এর বিভিন্ন দেশ থেকে ক্রয় করে লাগানোয় কাঙ্খিত উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ৪৫০ মেগাওয়াট নর্থ প্ল্যান্টে চুক্তি অনুযায়ী জি-৭ দেশের স্পেয়ার পার্টস দেয়ার কথা থাকলে তা লাগানো হয়নি। উক্ত কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টিআর ও টিএসকে নামক স্পেনের দুইটি কোম্পানি তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক ক্ষিতিশ চন্দ্র বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে চীন ও ভারতে তৈরী নিম্নমানের স্পেয়ার্স পার্টস দিয়ে প্ল্যান্টটি নির্মাণ করা হয়। যার ফলে ৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কোম্পানির একাধিক কর্মকর্তার দাবি, উক্ত প্রকল্পের কাজ করতে তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক ক্ষিতিশ চন্দ্র বিশ্বাস ইউরোপ ভ্রমনসহ কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বর্তমানে এপিএসসিএল’র নির্বাহী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন)’র পাশাপাশি নির্মানাধীন আশুগঞ্জ ৪০০ মেগাওয়াট (ইস্ট) প্রজেক্ট এর প্রকল্প পরিচালক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। যার ফলে বর্তমানে চলমান প্রকল্পের সকল ঠিকাদারি কাজ তার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। উক্ত প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনের সিএনটিআইসি নামক প্রতিষ্ঠানের কোনো কাজ লোকাল ঠিকাদারকে দিতে হলে আগে ক্ষিতিশ চন্দ্রের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে দিতে হয়। এই সুযোগে প্রতিদিন বিভিন্ন ঠিকাদারকে কাজ দেয়ার বিনিময়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তিনি।
এছাড়াও নির্মানাধীন উক্ত প্রকল্পের বিভিন্ন অব্যবহৃত মালামাল, তিনি কোনো প্রকার টেন্ডার ছাড়া বিক্রি করে দিচ্ছেন। অথচ, এরআগে এপিএসসিএল’র সকল প্রজেক্টে নির্মাণের সময় বিভিন্ন মালামালের স্ক্র্যাপ টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করে সরকারের কোটি কোটি টাকা আয় হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে নির্মাণাধীন প্রকল্প থেকে এপিএসসিএল কর্তৃপক্ষের কোনো আয় হয়নি।
গত ২৪ অক্টোবর উক্ত প্রজেক্টের অকেজো ক্যাবল ক্ষিতিশ চন্দ্রের আদেশে টেন্ডার ছাড়া বিক্রয় করার সময় ১টি ট্রাক আটক করে স্থানীয় জনগণ ও সাংবাদিকরা।
এ বিষয়ে স্থানীয় সাংবাদিকরা এপিএসসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অবগত করলে, তখন জরুরি ভিত্তিতে আদেশ জারি করে উক্ত মালামাল ডেলিভারি বন্ধ করেন তিনি।
এদিকে, আশুগঞ্জ ৪০০ মেগাওয়াট (ইস্ট) প্ল্যান্টটি ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে উৎপাদনে আসার কথা থাকলেও তা এখনও কমিশনিং শুরু হয়নি। শুধুমাত্র ক্ষিতিশ চন্দ্র বিশ্বাসের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য উক্ত প্ল্যান্টটির কাজ দেরি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কারণ উক্ত প্রজেক্ট এখনও শেষ হয়নি এই বিষয়টিকে বিবেচনা করে ক্ষিতিশ চন্দ্রের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
অপরদিকে, ক্ষিতিশ চন্দ্র নির্বাহী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) হওয়ার পর এপিএসসিএল আর কোনো নতুন প্ল্যান্টের প্রস্থাবনা আনতে পারেনি। অধিকন্তু প্রস্তাবিত পটুয়াখালী ১৩২০ মেগাওয়াট সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট, আশুগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট গ্রিড টাইড সোলার পার্ক নির্মাণ কাজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। এই প্লান্টের পেছনে সরকার প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা খরচ করার পরও কাজ শুরু করতে না পারায় গত বছরের শেষের দিকে তা বাতিল ঘোষণা করা হয়।
তবে, নির্বাহী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ক্ষিতিশ চন্দ্র তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এসব বিষয় বোর্ড দেখবে।
করোনার কারণে আশুগঞ্জ ৪০০ মেগাওয়াট (ইস্ট) প্ল্যান্টের কাজ নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে না। প্লান্টের কাজে নিয়োজিত চাইনিজরাতো ছুটি পাননি তাহলে করোনার প্রভাব এতটা পড়লো কীভাবে?- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তার বিরোধীরা কত কথাই বলবে, এগুলো ধরে লাভ নেই।
এ এসব বিষয়ে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম এম সাজ্জাদুর রহমান বলেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রভাবতো কিছুটা আছেই। কোন অনিয়ম হয়ে থাকলে খতিয়ে দেখা হবে। এছাড়া যে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য বোর্ড রয়েছে বলে জানান তিনি।
বিএনএনিউজ/গোলাম সারোয়ার,আরকেসি