বিএনএ, ঢাকা: ১১ আগস্ট থেকে পবিত্র মহররম মাস গণনা শুরু হবে। সে ক্ষেত্রে আগামী ২০ আগস্ট শুক্রবার পবিত্র আশুরা পালিত হবে।সোমবার (৯ আগস্ট) সন্ধ্যায় জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয় ও জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সূত্রমতে,
মঙ্গলবার (১০ আগস্ট) জিলহজ মাসের ৩০ দিন পূর্ণ হবে। বুধবার থেকে মহররম মাস গণনা শুরু হবে। আগামী ২০ আগস্ট (১০ মহররম) শুক্রবার দেশে পবিত্র আশুরা পালিত হবে।
আশুরা কী ? ১০ মহররম ইসলামের ইতিহাসে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ
আরবী বর্ষ বা হিজরি সনের প্রথম মাস হল মহররম।
মহররম শব্দের অর্থ-
অলঙ্ঘনীয় পবিত্র; সম্মানিত
মর্যাদাপুর্ণ; তাৎপর্যপুর্ণ
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাসের সংখ্যা ১২। যেদিন থেকে তিনি সব আসমান ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তন্মধ্যে চারটি হলো সম্মানিত মাস। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং তোমরা এ মাসগুলোর সম্মান বিনষ্ট করে নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।’ (সুরা তাওবা : ৩৬)
এখানে আল্লাহ তায়ালা যে চারটি সম্মানিত মাসের কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলো হল জিলক্বাদ, জিলহজ, মহররম এবং রজব মাস। জাহেলী যুগের লোকেরাও এই চারটি মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ, লুটপাট, রক্তপাত, হানাহানি ইত্যাদি থেকে বিরত থাকত।
হাদিস শরিফে মহররমকে ‘শাহরুল্লাহ’ বা আল্লাহর মাস বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
মহররম মাস সম্মানিত হওয়ার বিশেষ একটি কারণ হচ্ছে আশুরা।
আশুরা কি?
মহররমের ১০ম দিনকে আশুরা বলা হয়। আশুরা শব্দটি আরবী শব্দ ‘আশারা’ থেকে নেয়া হয়েছে। এর অর্থ ১০। পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই এই দিনে সংঘটিত হয়েছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা। হাদিস ও অন্যান্য গ্রন্থ থেকে পাওয়া সেসব ঘটনাগুলি হল-
১। আল্লাহ তায়ালা এই দিনেই আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেন।
২। পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদম (আঃ) কে এই দিনেই সৃষ্টি করা হয়।
৩। এই দিনেই আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ) কে দুনিয়ায় প্রেরণ করা হয়।
৪/ মহাপ্লাবনের সময় নূহ (আঃ) এর নৌকা এই দিনেই পর্বতে গিয়ে ঠেকেছিল।
৫/ মূসা (আঃ) ও তাঁর অনুসারীদেরকে আল্লাহ তায়ালা এই দিনে ফিরাউনের হাত থেকে বাচান এবং ফিরাউনকে লোহিত সাগরে ডুবিয়ে মারেন।
৬/ ইব্রাহীম (আঃ) কে আগুনে ফেলা হলে আগুন তাঁর জন্য শীতল হয়ে যায়। সেটা ছিল এই দিন।
৭/ আইয়ুব (আঃ) দুরারোগ্য অসুখ থেকে পরিত্রাণ পেয়েছিলেন এই দিনেই।
৮/ এই দিনেই ঈসা (আঃ) কে আল্লাহ তায়ালা ঊর্ধাকাশে উঠিয়ে নিয়েছিলেন।
৯। ইউনূস (আঃ) মাছের পেট থেকে এই দিনেই মুক্তি লাভ করেন।
১০/ ইউসুফ (আঃ) ও তাঁর পিতা ইয়াকুব (আঃ) এর সাথে এই দিনেই বহু বছর পর দেখা হয়।
১১/ দাউদ (আঃ) এর তাওবা কবুল হয় এই দিনে।
১২/ সুলাইমান (আঃ) পুনরায় রাজত্ব লাভ করেন এই দিনে।
১৩/ ইদ্রিস (আঃ) কে আল্লাহ জান্নাতে উঠিয়ে নেন এই দিনে।
১৪/ কারবালার ময়দানে এই দিনে হোসাইন (রাঃ) তাঁর সঙ্গী সাথীদের নিয়ে নির্মমভাবে শাহাদাৎ বরণ করেন।
১৫/ এই দিনেই কেয়ামত সংগঠিত হবে।
পবিত্র আশুরা (১০ মহররম) মুসলিম উম্মাহর কাছে ঐতিহাসিকভাবে প্রসিদ্ধ ও পরিচিত। কারবালা প্রান্তরে হজরত মুহাম্মদের (স.) দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসেনের (রা.) শাহাদাতবরণের শোকাবহ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মূলত আমাদের দেশে আশুরা পরিচিত। তবে ইসলামের ইতিহাসে পবিত্র আশুরা আরও কিছু তাৎপর্যময় ঘটনায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। আশুরার রোজা (আশুরার দিন এবং আগে বা পরে একদিন) রাখার বিষয়ে বিশেষ ফজিলতের কথা বলা হয়েছে হাদিসে।
আশুরা (মহররমের ১০ তারিখ)। পৃথিবী সৃষ্টির পর হতে আশুরার দিনে সংঘটিত হয়েছে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা ও হৃদয়বিদারক কাহিনী। এখানে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো। আশুরার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ঘটনা হচ্ছে- হজরত মুসা (আ.)-এর ফিরআউনের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি লাভ। এই দিনে মহান আল্লাহ তায়ালা চিরকালের জন্য লোহিত সাগরে ডুবিয়ে শিক্ষা দিয়েছিলেন ভ্রান্ত খোদার দাবিদার ফিরআউন ও তার বিশাল বাহিনী।
অনেকে মনে করেন, ফিরআউন নীলনদে ডুবেছিল। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুযায়ী এই ধারণা ভুল। বরং তাকে লোহিত সাগরে ডুবিয়ে বিশ্ববাসীকে শিক্ষা দেওয়া হয়। এ ঘটনা ইমাম বুখারি তাঁর কিতাবে এভাবে বর্ণনা করেন- ‘হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী (সা.) যখন হিজরত করে মদিনা পৌঁছেন, তখন তিনি দেখলেন যে মদিনার ইহুদি সম্প্রদায় আশুরার দিনে রোজা পালন করছে।
তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেন, আশুরার দিনে তোমরা রোজা রেখেছ কেন? তারা উত্তর দিল, এই দিনটি অনেক বড়। এই পবিত্র দিনে মহান আল্লাহ মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে ফিরআউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন আর ফিরআউন ও তার বাহিনী কিবতি সম্প্রদায়কে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হজরত মুসা (আ.) রোজা রাখতেন, তাই আমরাও আশুরার রোজা পালন করে থাকি। তাদের উত্তর শুনে নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, হজরত মুসা (আ.)-এর কৃতজ্ঞতার অনুসরণে আমরা তাদের চেয়ে অধিক হকদার। অতঃপর তিনি নিজে আশুরার রোজা রাখেন এবং উম্মতকে তা পালন করতে নির্দেশ প্রদান করেন। (বুখারি-৩৩৯৭, মুসলিম-১১৩৯)
আশুরার রোজা :
মহররম মাসে ১০ তারিখে রোজা রাখার ফজিলত সম্পর্কে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। একটি হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয়, রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা উম্মতে মুহাম্মদীর ওপর ফরজ ছিল। পরবর্তী সময়ে অবশ্যই ওই বিধান রহিত হয়ে যায় এবং তা নফলে পরিণত হয়। হাদিস শরিফে হজরত জাবের (রা.) সূত্রে বর্ণিত আছে- ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের আশুরার রোজা রাখার নির্দেশ দিতেন এবং এর প্রতি উৎসাহিত করতেন। এ বিষয়ে নিয়মিত তিনি আমাদের খবরাখবর নিতেন। যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হলো, তখন আশুরার রোজার ব্যাপারে তিনি আমাদের নির্দেশও দিতেন না এবং নিষেধও করতেন না। আর এ বিষয়ে তিনি আমাদের খবরাখবরও নিতেন না। (মুসলিম শরিফ-১১২৮)
আশুরার রোজার ফজিলত : রাসুলুল্লাহ (সা.) এই রোজা নিজে পালন করেছেন এবং উম্মতকে রাখার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। তাই এর পূর্ণ অনুসরণ ও আনুগত্যের মধ্যেই নিহিত রয়েছে উম্মতের কল্যাণ। এ ছাড়া অসংখ্য হাদিসে আশুরার রোজার ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। এ বিষয়ে কয়েকটি হাদিস শুনি- ‘হজরত আবু কাতাদা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.)-কে আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এই রোজা বিগত বছরের গুনাহ মুছে দেয়। (মুসলিম-১১৬২)। ‘রাসুল (সা.) বলেন- ‘রমজান মাসের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা আল্লাহর মাস মহররমের আশুরার রোজা।’ (সুনানে কুবরা-৪২১০)
আশুরার রোজা ও ইহুদি সম্প্রদায় : মুসলিম শরিফে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত- ‘মহানবী (সা.) যখন আশুরার দিনে রোজা রাখেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার নির্দেশ প্রদান করেন, তখন সাহাবিরা অবাক হয়ে বলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! ইহুদি-নাসারারা তো এই দিনটিকে বড়দিন মনে করে। (আমরা যদি এই দিনে রোজা রাখি, তাহলে তো তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য হবে। তাদের প্রশ্নের উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, ‘তারা যেহেতু এদিন একটি রোজা পালন করে) আগামী বছর ইনশাআল্লাহ আমরা এই ১০ তারিখের সঙ্গে ৯ তারিখ মিলিয়ে দুই দিন রোজা পালন করব। (মুসলিম-১১৩৪)
আশুরার দিনে অন্য একটি আমল : ‘হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আশুরার দিনে আপন পরিবার-পরিজনের মধ্যে পর্যাপ্ত খানাপিনার ব্যবস্থা করবে, আল্লাহপাক পুরো বছর তার রিজিকে বরকত দান করবেন। (তাবরানি : ৯৩০৩) ।
আল্লাহর উপর দৃঢ় বিশ্বাস এবং ভরসা থাকলে আল্লাহ অবশ্যই সমস্ত বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করবেন। আল্লাহর পথে কাজ করতে গেলে অবশ্যই বিপদ আসবে কিন্তু সেসব বিপদ থেকে অভাবনীয় উপায়ে উদ্ধার করবেন আল্লাহ নিজেই।মহররম ও আশুরা দিবসে করোনার মত মহামারীর কবল থেকে সারাবিশ্বের মানুষকে যাতে মহানআল্লাহতায়ালা হেফাজত করেন, আসুন সকলে মিলে সেই দোয়া করি। সংগৃহীত।