।। হামিমুর রহমান।।
বিএনএ, ময়মনসিংহ: আষাঢ়ের বৃষ্টিতে নদীতে ঢল নামে। খাল-বিল, নদী-নালা বৃষ্টির পানিতে হয় টইটম্বুর। এবার আষাঢ় যায় যায়, খাল-বিল, নদী-নালায় নেই বৃষ্টির পানি। নেই বর্ষার সেই চিরচেনা রুপ। তবুও বর্ষার আশায় গ্রাম-গঞ্জে চলছে নৌকা তৈরির কাজ। বর্ষার এসময়ে ব্যস্ত সময় পার করছে নৌকা তৈরির কারিগররা।
এই মৌসুমে ব্যস্ত সময় পার করছেন ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার বিলডোরা ইউনিয়নের দাড়িয়াকান্দা গ্রামের নৌকা তৈরির কারিগররা। বছরের আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস নৌকা তৈরির কাজ করলেও বাকি ১০ মাস করতে হয় শ্রমিকের কাজ। এই মৌসুমে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই দাড়িয়াকান্দা গ্রামে চলে নৌকা তৈরির কাজ। এভাবে চলে আসছে বহু দশক ধরে।
হালুয়াঘাট নিচু এলাকা হওয়ায় উপজেলার বেশ কিছু গ্রাম ও ইউনিয়ন বর্ষা মৌসুমের পানিতে তলিয়ে থাকত। তাই এখানে মানুষের চলাচলের প্রধান বাহনও ছিল নৌকা। বহু আগে থেকে এই অঞ্চলের লোকেরা নৌকা তৈরির কাজ করে আসছেন। এই অঞ্চলে তৈরি নৌকার কদরও ছিল দেশজুড়ে। তাই, আশেপাশের জেলা ও উপজেলার লোকেরা নৌকা কেনার জন্য চলে আসতেন হালুয়াঘাটে। এখনও অনেকে বাপ-দাদার পেশাকে টিকিয়ে রেখেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই গ্রামের খোলা মাঠে কারিগররা নৌকা তৈরির কাজ করেন। নৌকা তৈরিতে চারটি কাঠের পাটাতনের উপর পেরেকের সাহায্যে কাঠ জোড়া দিয়ে নৌকা তৈরির কাজ শুরু করতে হয়। এই কাজ বেশ কয়েকজন মিলে-মিশে করছেন। কেউ কেউ কাঠ কেটে দিচ্ছেন, আবার কেউ জোড়া দিচ্ছেন, কেউবা আবার নৌকার তলা তৈরির কাজ করছেন।
নৌকার তৈরির কারিগরদের সাথে কথা বলে জানা যায, নৌকা তৈরিতে খুব কম দামি কাঠ ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে যে কাঠ দীর্ঘদিন পানিতে থাকলেও পঁচে না। এমন কাঠের মধ্যে রয়েছে মেরা গাছ, রেইন্টি গাছ, আকাশ মনি বা ইউক্যালিপটাস গাছ, জারুল গাছ। আকার ভেদে নৌকার দাম হয়। তবে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেশি দামে নৌকা বিক্রি করতে হচ্ছে।
খাইরুল ইসলাম নামে নৌকার এক কারিগর বলেন, আমার বাবা হামিদ মিস্ত্রী। তিনিও নৌকা তৈরির কাজ করতেন। উনার সাথে থেকে আমরা পাঁচ ভাইয়ের সবাই নৌকা তৈরির কাজ করি। আমি ১৫ বছর যাবত এই কাজের সাথে জড়িত। একজন তিন দিনে একটি নৌকা করতে পারবেন। মৌসুমে ২০ থেকে ২৫ টি নৌকা তৈরি করা সম্ভব। এসব নৌকা আকার ও কাঠ ভেদে ৮ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়।
তিনি বলেন, নিচু এলাকা হওয়ায় এই অঞ্চলে নৌকার অনেক চাহিদা। তবে এবার সময় মত পানি না হওয়ার কারণে অন্যান্য বছরের তুলনায় চাহিদা অনেক কম। যারা কৃষি কাজের সাথে জড়িত তাদের ধান, পাট, সবজি বাজারে নিয়ে আসার জন্য নৌকা প্রয়োজন হয়। তাছাড়া মাছ ধরার জন্য জেলেরাও নৌকা কিনে নেয়। বর্ষা মৌসুমে নৌকা তৈরির কাজ করি। আর অন্য মৌসুমে শ্রমিকের কাজ করি।
নৌকা তৈরির আরেক কারিগর মো. আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, নৌকা তৈরিতে আমরা মেরা গাছ, রেইন্ট্রি গাছ, আকাশ মনি বা, ইউক্যালিপটাস গাছ, জারুল গাছ ব্যবহার করে থাকি। কারণ এই জাতীয কাঠ দীর্ঘদিন পানিতে থাকলেও পঁচে না। প্রতি বছরই তো কম-বেশি বৃষ্টি হয়, নদী-নালা, খালে-বিলে পানি হয়। এই বছর বৃষ্টি কম হওয়ায় পানি হয়নি। তাই নৌকার চাহিদাও কম। যদি পানি বাড়ে তাহলে নৌকার চাহিদা বাড়বে। একটি নৌকা বিক্রি করতে পারলে কমপক্ষে ২ হাজার টাকা লাভ হয়। তবে সম্প্রতি কাঠ ও পেরেকের দাম বাড়ায় লাভ কিছুটা কমে আসছে। আর লাভ-লোকসানের হিসাবের চাইতে বড় বিষয় হলো, বাপ-দাদার পেশা ধরে রাখা।
নৌকা কিনতে আসা হৃদয় বলেন, এখন নৌকার দাম বেশি। ৮ হাজার টাকার নিচে কোন নৌকা নাই। নৌকা ছাড়া আমাদের চলে না। কারণ আমরা নিচু এলাকার মানুষ। একটি ফিসারী আছে। নৌকা ছাড়া ফিসারীতে যেতে পারি না। তাই নৌকা কেনা আমার জন্য জরুরি। ৮ হাজার টাকা দিয়ে একটি নৌকা কিনেছি।
স্থানীয় ইউপি সদস্য হাবিল উদ্দিন বলেন, অনেক আগে থেকেই এখানে নৌকা তৈরি হয়। শুধু এই গ্রামেই না উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এই সময় নৌকা তৈরি হয়। সারাদেশ জুড়েই আমাদের এই নৌকার চাহিদা রয়েছে।
বিলডোরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাবজাল হোসেন খান জানান, বর্ষা মৌসুম দাড়িয়াকান্দাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় নৌকা তৈরির কাজ হয়। আমাদের এখানে নৌকার চাহিদাও অনেক বেশি। আশপাশের উপজেলা ও জেলা থেকে এখানে অনেকে নৌকা কিনতে আসেন। নৌকা তৈরিতে কারিগরদের কোনো সহায়তার প্রয়োজন হলে আমরা তাদের পাশে থাকবো।
বিএনএ/হামিমুর, এমএফ