বিএনএ,ঢাকা: এই বছরের ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলন ‘ব্যর্থ’ হওয়ার পর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ( বিএনপি)র নেতাকর্মীরা তাদের দলের রাজনৈতিক কৌশলের ‘অডিট’ করতে শুরু করেছেন। প্রাথমিক নিরীক্ষায় দেখা গেছে তাদের হিসাব নিকাশের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বেশ গরমিল। ফলে হতাশা দেখা দিয়েছে দলটির তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকারকে বিভিন্ন দেশের সমর্থন এবং সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দেওয়ার পর দলের নেতাকর্মীরা বেশ বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন।
নির্বাচনের পর সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা বা জোরালো পদক্ষেপ আসবে বলে যে গুঞ্জন ছিল, বাস্তবে তা এখনো দেখা যায়নি। এছাড়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কার্যক্রম ও বক্তব্যে নেতাকর্মীরা কোনো ধরনের আশা দেখতে পাচ্ছেন না।
বিএনপি নেতাদের অনেকের অভিযোগ, লন্ডনে একটি চক্রদ্বারা বেষ্টিত থাকেন তারেক রহমান। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ওই চক্রই তাঁকে প্রভাবিত করে। এ জন্য অনেক সিদ্ধান্ত ঘোষণার আগে দলের বেশির ভাগ জ্যেষ্ঠ নেতা কিছুই জানতে পারেন না। এর একটি ছিল, নির্বাচনের আগে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক।
এদিকে নির্বাচন ঘিরে সরকার পতন আন্দোলনে পরিকল্পনায় ভুল ও কূটনৈতিক তৎপরতায় ব্যর্থতা ছিল বলে শরিক দলগুলোর মূল্যায়নে উঠে এসেছে। নির্বাচনের পর তারেক রহমানের সঙ্গে দলের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর ধারাবাহিক বৈঠকে শরিক দলের নেতারা বলেন, অসহযোগ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত বাস্তবতার নিরিখে নেওয়া হয়নি। কূটনীতিতে বিএনপি নেতারা ব্যর্থ ছিলেন। আন্দোলনের ডাক দিয়ে বিএনপি নেতারা মাঠে ছিলেন না। নির্বাচনের পরই হঠাৎ কর্মসূচি বন্ধ করাও অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত ছিল। এমনকি হঠাৎ বিএনপির ভারতবিরোধী রাজনীতির সমালোচনা করেন শরিকদের কেউ কেউ।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা ও গ্রহণযোগ্যতার অভাব রয়েছে তারেক রহমানের। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর খালেদা জিয়া যেভাবে বিএনপির হাল ধরেছেন, তারেক রহমান সেভাবে বিচক্ষণতা দেখাতে পারেননি।
পরাশক্তি দেশগুলোর কাছে তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে এক ধরনের আস্থাহীনতা আছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা রাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো প্রভাবশালী দেশের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হতে না পারলে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি বেশিদূর এগোতে পারবে না।
বিএনপি দলের নেতারা মনে করেন, ২০১৪ সালে একেবারে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে বিএনপির আন্দোলন অনেক তীব্র ছিল। সে সময় গুম ও ক্রসফায়ারের ঘটনার মধ্যে নেতাকর্মীরা লড়াই করেছেন। হরতাল-অবরোধে তখন কার্যত দেশ অচল ছিল। জনমনে আতঙ্ক ও ভীতি ছিল। এবার বাংলাদেশের নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি ঘোষণার পর সরকার চাপে ছিল। কিন্তু সেই প্রেক্ষাপটকে কাজে লাগাতে পারেনি বিএনপি নেতৃত্ব।
২০১৮ সালে খালেদা জিয়ার সাজা হওয়ার পর দলের হাল ধরেন তারেক রহমান। বিএনপিতে একক কর্তৃত্ব তৈরি করতে গিয়ে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নিজের পছন্দ ও বিশ্বস্ত নেতাদের দিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কমিটি গঠন করেন তিনি। ফলে হঠাৎ সাংগঠনিক কমিটিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে রাজনীতি করেছেন এমন অনেক ত্যাগী ও জ্যেষ্ঠ নেতা গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে বাদ পড়ে যান।
ফলে সাংগঠনিক গতিশীলতা কমতে থাকে, দলে এক ধরনের স্থবিরতা তৈরি হয়। কিন্তু দেশব্যাপী তাঁর বিশ্বস্ত নেতা এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা সরকার ‘ফেলে’ দেওয়ার সক্ষমতা রাখেন এমন ধারণা দেন তারেক রহমানকে। কিন্তু আন্দোলনের মাঠে তাঁদের তৎপরতা ছিল না বললেই চলে।
যদিও বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী দাবি করেন সারা দেশে চৌকস ও দক্ষ নেতাদের দিয়ে কমিটি গঠন করেছেন তারেক রহমান। সরকারের দমন-পীড়নের পরও তাঁর নেতৃত্বে দল ঐক্যবদ্ধ আছে।
আন্দোলনের সময় নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত দল এবং দলের দায়িত্বশীল পর্যায়ে যোগাযোগ রাখতেন ভারতের শিলংয়ে অবস্থানরত স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ। তিনি তারেক রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ২০১৫ সালের ১১ মে থেকে সালাহ উদ্দিন শিলংয়ে আছেন। প্রায় ৯ বছর দেশে না থেকেও কিভাবে তিনি আন্দোলন সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকেন তা নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে।
বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের দায়িত্বে ছিলেন তারেক ঘনিষ্ঠ দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি এখন কারাগারে আছেন। আন্দোলনের পর এখন দলে তাঁকে নিয়ে সমালোচনা বেশি হচ্ছে। তাঁর অনুস্থিতিতে কাজ করতে গিয়ে দলের অন্য জ্যেষ্ঠ নেতারা বুঝতে পেরেছেন, কূটনৈতিক পর্যায়ে নিরন্তর যোগাযোগ ছিল না তাঁর। শুধু চিঠি চালাচালি আর ইস্যুভিত্তিক দেখা-সাক্ষাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল দলীয় কার্যক্রম। ফলে কূটনৈতিক পর্যায়ে বিএনপির সঙ্গে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সেভাবে বোঝাপড়া গড়ে ওঠেনি। যদিও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সঙ্গে বিএনপির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা প্রচার করে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের বিদেশনির্ভরতা তৈরি করেন আমির খসরু ও তাঁর ঘনিষ্ঠরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আন্দোলন চলাকালে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব পরিপক্বতা দেখাতে পারেননি। দূরদর্শিতার অভাবে নির্বাচনের পরই হঠাৎ আন্দোলন বন্ধ করে দেওয়া এবং সরকারের ওপর যে ধরনের চাপ তৈরি করতে হয় সে ধরনের পরিকল্পনা বিএনপির ছিল না।
তা ছাড়া পরাশক্তি তিনটি দেশের ভূমিকা ও সরকারের দমন-পীড়নের ভয়ংকর রূপও আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তাঁরা। ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও বিএনপির বিরুদ্ধে ছিল। দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে অনেকের মধ্যে হতাশা এসেছে। এই অবস্থায় গতানুগতিক কর্মসূচী দিয়ে নেতাকর্মীদের রাজপথে ফেরানো কঠিন হবে। তাঁদের মধ্যে আশা জাগাতে না পারলে ব্যাপকসংখ্যক নেতাকর্মী হারাবে বিএনপি এমনটাই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিএনএ/ শামীমা চৌধুরী শাম্মী, ওজি/এইচমুন্নী