বিএনএ, ডেস্ক : আবারও পাকিস্তান ঝুলন্ত একটি সংসদ পেতে যাচ্ছে । প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দল এককভাবে সরকার গঠন করার জন্য ১৩৪ আসন পায়নি। সরকার গঠনের বল এখন বিলওয়াল ভুট্টো জারদারি এবং তার পাকিস্তান পিপলস পার্টির কোর্টে। ট্রিপল ‘পি’র দলটিই এখন হয়ে উঠেছে ক্ষমতার ভারসাম্যের দাড়ি পাল্লা।
নির্বাচনে এখন পর্যন্ত যে ফলাফল, তাতে কোনও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। যে দলই পাকিস্তানে সরকার গঠন করুক না কেন তা হবে জোড়াতালির সরকার। এতে সেনা বাহিনীই লাভবান হবে। যেমনটা হয়েছে ইমরান খানকে ইমপিসমেন্ট করার ক্ষেত্রে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর ছায়ায় ১১৭ আসন পায় এবং খুচরা দল ও স্বতন্ত্রদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। ওই সময় সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ দূর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে ক্ষমতার ধারাবাহিকতা থেকে দূরে থাকতে হয়। তবে ২০২৪ সালের নির্বাচনের প্রেক্ষাপট পুরো উল্টো।
প্রসঙ্গত, ২০২২ সালে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান বিলওয়াল ভুট্টো জারদারি। অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করা ৩৫ বছর বয়সী এই রাজনীতিক পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো এবং প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির ছেলে। বেনজির ভুট্টো ২০০৭ সালে বাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে ৫৪ বছর বয়সে এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন।
তবে এবারের নির্বাচনে ভোট কারচুপি হোক বা না হোক, সেনাবাহিনীর সুনজরে থাকার কারণে চতুর্থবারের মতো ফের নওয়াজ শরিফ ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছেন বলে ধারণা করছেন অনেক বিশ্লেষক।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও তার দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে বলে মনে করা হচ্ছিল। যদিও তার এমন উন্নতি কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। কারণ মাত্র ছয় বছর আগে, অর্থাৎ গত নির্বাচনের সময় দুর্নীতির দায়ে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল তাকে। স্বেচ্ছা নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু সম্প্রতি তিনি নির্বাসন থেকে ফিরেছেন। গত বছর তার বিরুদ্ধে দেওয়া ক্ষমতায় আসতে আজীবন নিষেধাজ্ঞা বাতিল করা হয়েছে। সরিয়ে ফেলা হয়েছে তার সব অপরাধের রেকর্ডও। সবমিলিয়ে সেনাবাহিনীর সমর্থনে তিনি আবারও নির্বাচনে অংশ নিতে পেরেছেন।
পাকিস্তান মুসলিম লীগ–নওয়াজের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নওয়াজ শরিফ বলেছেন, দেশের জাতীয় নির্বাচনে তাঁর দল ‘বিজয়ী’ হয়েছে। এখন তিনি একটি ঐক্যের সরকার গঠন করতে চান।
৯ জানুয়ারি নির্বাচনের ফল ঘোষণার মধ্যেই লাহোরে পিএমএল-এনের প্রধান কার্যালয়ে সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন নওয়াজ শরিফ। এ সময় তাঁকে আতশবাজির মাধ্যমে স্বাগত জানানো হয়।
নওয়াজ শরিফ বলেন, ঐক্য সরকার গঠনের জন্য তিনি ছোট ভাই শাহবাজ শরিফকে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতা আসিফ আলী জারদারি, জমিয়ত উলেমা ইসলাম-ফজলের (জেইউআই-এফ) নেতা ফজলুর রেহমান এবং মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট-পাকিস্তানের (এমকিউএম-পি) নেতা খালিদ মকবুল সিদ্দিকীর সঙ্গে কথা বলতে বলেছেন।
এ দিকে দেশটির কারাগারে আটক সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) প্রতিষ্ঠাতা ইমরান খান। কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরার লাইভ প্রতিবেদনে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইমরানের এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে এই নির্বাচনে জাতির নজিরবিহীন লড়াইয়ের কথা উল্লেখ করে জনগণকে অভিনন্দন জানানো হয়। সবমিলিয়ে নির্বাচনের পর পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমিকরণ জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠেছে।
ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় গোপন নথি পাচারের অভিযোগে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এখন জেলবন্দী থাকলেও ফলাফলে দেখা যাচ্ছে তার দল সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভালো করছে। যদিও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
যে রাজনীতিবিদ এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছেন তিনি হচ্ছেন ক্রিকেট ছেড়ে রাজনীতিতে আসা ইমরান খান। তাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে ক্ষান্ত হয়নি, তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) এর প্রতীক ক্রিকেট ব্যাটও কেড়ে নিয়েছে পাকিস্তানের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ফলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে ইমরান খানের দল পিটিআই।
দমন-পীড়ন সত্ত্বেও এই নির্বাচনকে ‘স্বতন্ত্র প্রার্থীদের আধিপত্য’ বলে বর্ণনা করেছে পাকিস্তানের সম্প্রচার মাধ্যম জিও নিউজ।
ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) নতুন চেয়ারম্যান গহর আলী খান পরের অবস্থানে থাকা প্রতিযোগীর তিনগুণ বেশি ভোট পেয়ে খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বুনার আসন থেকে জয় লাভ করেছেন।
তিনি গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি দলটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হন। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জেল থেকেই তাকে মনোনীত করেন। দলটির আরেক জৈষ্ট্য নেতা আসাদ কায়সার, যিনি সংসদের সাবেক স্পিকার ছিলেন তিনিও খাইবার পাখতুনখোয়া’র সোয়াবি আসন থেকে জয়যুক্ত হয়েছেন।
পিটিআই প্রার্থীরা ‘ক্রিকেট ব্যাট’ প্রতীকের অধীনে নির্বাচন করতে পারবে না, নির্বাচন কমিশন এরকম একটা আইন জারি করায় এই প্রার্থীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধ্য হয়েছে।
সার্বিকভাবে পাকিস্তানের ভোটারগণ নির্বাচনে নওয়াজ শরীফের দলকে একক সংখ্যাগরিষ্টতা না দিয়ে সেনাবাহিনীকে একটি বার্তা দিয়েছে তা হচ্ছে ,বুলেটের চেয়ে ব্যালটই শক্তিশালী।
একই সঙ্গে এটি প্রমাণিত হয়েছে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান গত বছর থেকে কারাগারে থাকলেও ভোটের মাঠে এখনও তার ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে।গত সপ্তাহে তাকে আবারও কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) সদস্যরা এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, নির্বাচনের ফলাফলে ইমরান খানের দল পিটিআই প্রার্থীরা স্বতন্ত্রভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে লড়াই করে বেশি আসন পেলেও, সেনাবাহিনীর সুনজর থাকায় শেষ পর্যন্ত সরকার গঠন করবে নওয়াজ শরীফের দল পিএমএল। যদিও প্রাপ্ত ফলাফল ভিন্ন কথা বলছে। এই পরিস্থিতিতে দেশটির প্রায় ১২ কোটি ৮০ লাখ ভোটারের সঙ্গে সারা বিশ্বের রাজনৈতিক সচেতন শত কোটি মানুষ এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন কে হতে যাচ্ছেন পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।
বিএনএ/ শামীমা চৌধুরী শাম্মী, ওজি/এইচমুন্নী