বিএনএ : জাপানের নারা শহরে ক্যাম্পেইনে বক্তব্য দিচ্ছিলেন দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। বক্তৃতা দেয়ার সময় পর পর দুটি গুলির শব্দ। তাকে লক্ষ্য করেই ছোড়া হয় গুলি। লুটিয়ে পড়েন আবে। হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। ডাক্তারদের প্রবল চেষ্টার পরও পৃথিবী থেকে বিদায় নেন আবে। ২০২২ সালের ৮ জুলাই এ ঘটনা ঘটে। তবে আবের আগেও অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মারা গেছেন আতাতায়ীর গুলিতে।
শিনজোকে হত্যা করেন টেটসুয়া ইয়ামাগামি নামে এক জাপানি। তাকে আটক করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, শিনজোর কাজে সন্তুষ্ট ছিলেন না তিনি। তাই তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। হত্যা করেছেন।
শিনজোর মতোই প্রাণঘাতী হামলার শিকার হয়েছে বহু রাষ্ট্রনায়ক, রাষ্ট্রনেতা, দেশনেতা।
আব্রাহাম লিঙ্কন :
আব্রাহাম লিঙ্কন ছিলেন আমেরিকার ষোড়শ প্রেসিডেন্ট। তাঁকে ১৮৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল, একটি থিয়েটারে মাথার পিছন থেকে গুলি করে খুন করেন জন ওয়াইকস বুথ। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ লিঙ্কনের ওপর হামলা হয়। পরের দিন সকাল ৭টায় মৃত্যু হয় তাঁর।
লিঙ্কনের মৃত্যুর কারণ হিসেবে তাঁর দাসপ্রথা বন্ধের আইনকেই দায়ী করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁর হন্তক বুথ ছিলেন দাস প্রথার অন্যতম সমর্থক।
মারি ফ্রাসোঁয়া সাদি
১৮৯৪ সালে ফরাসি প্রেসিডেন্ট মারি ফ্রাসোঁয়া সাদি কার্নটকে ছুরি মেরে খুন করেন সাঁতে জেরোনিমো সিজেরিও। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ফরাসি প্রেসিডেন্ট কার্নট তখনও সাত বছর পূর্ণ করেননি। অথচ এরই মধ্যে জনতার বিপদে-আপদে তাঁর যথা সময়ের উপস্থিতি তাঁকে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে দেয়। লোকের মুখে মুখে কার্নটের সততা, নীতিপরায়ণতার কথা। সেই সময়েই একটি জনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে খুন হন কার্নট।
হত্যাকারী কার্নটের সামনে গিয়ে তাঁর পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়। ১৮৯৪ সালের ২৪ জুন এই ঘটনার পরের দিনই মারা যান কার্নট। তদন্তকারীরা জানান, এক ফরাসি নৈরাজ্যবাদীর মৃত্যুদণ্ডের প্রতিশোধ নিতেই ওই হামলা করা হয় কার্নটের ওপর। খুনি সিজেরিও নিজেও ছিলেন সেই নৈরাজ্যবাদীদেরই একজন।
লিওন ট্রটস্কি
লেনিনের ভাবশিষ্য ছিলেন মার্কসবাদী বিপ্লবী লিওন ট্রটস্কি। তিনি ছিলেন রুশ বিপ্লবের প্রথম সারির নেতা। ১৯৪০ সালের ২১ অগস্ট তাঁকে হত্যা করা হয়। জাইমে রেমন মার্সেডার ডেল রিয়ো নামে এক স্প্যানিশন কমিউনিস্ট কর্মী তাঁকে হত্যা করেন বরফ কাটার কুড়ুল দিয়ে। তাঁকে তাঁর পড়ার ঘরে ঢুকে আক্রমণ করা হয়েছিল। তবে তার পরও এক দিন বেঁচে ছিলেন ট্রটস্কি।
মার্টিন লুথার কিং :
মার্টিন লুথার কিং ছিলেন আমেরিকান ব্যাপ্টিস্ট মন্ত্রী এবং আফ্রিকান-আমেরিকান মানবাধিকার কর্মী। আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার গণআন্দোলনের নেতা ছিলেন মার্টিন। ভারতের মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরোধিতা করে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৬৮ সালে মার্টিনকে সামনে থেকে গুলি করে খুন করে জেমস আর্ল রে নামে এক শ্বেতাঙ্গ যুবক। জেমস ছিল দাগী আসামি। বহু বার জেল খেটেছে, জেল থেকে পালিয়েওছে। ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল মার্টিনকে খুন করে জেমস। মার্টিন একটি মোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তখন। জেমস ছিলেন হোটেলের গা ঘেঁষা অন্য একটি বাড়ির লাগোয়া ঘরে।
মোহনদাস করমচাঁদ গাঁধী
নাথুরাম গডসের হাতে খুন হন মোহনদাস করমচাঁদ গাঁধী। রাষ্ট্রনেতা না হলেও গাঁধী দেশনেতা। তাঁকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধা মনে করেন দেশের একটি বড় অংশ। গাঁধী দিল্লিতে তাঁর সান্ধ্যকালীন প্রার্থনাসভায় যোগ দিতে যাচ্ছিলেন ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি। তাঁকে সামনে থেকে বুকে পর পর তিনটি গুলি করেন হিন্দুত্ববাদী নাথুরাম।
জন এফ কেনেডি
আমেরিকার ৩৫ তম প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে হত্যা করা হয় ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর ডালাসে। হুড খোলা গাড়িতে সওয়ারি ছিলেন সস্ত্রীক প্রেসিডেন্ট। তাঁর হন্তক লি হার্ভে ওসওয়াল্ড রাস্তার ধারের একটি বাড়ির ছ’তলা থেকে প্রেসিডেন্টের মাথা লক্ষ্য করে তিনটি গুলি চালান। প্রমাণ না হলেও কেনেডির হত্যাকাণ্ডে তাঁর দলেরই অন্তর্ঘাতের অভিযোগ উঠেছিল। ওসওয়াল্ডকে অবশ্য এই ঘটনার দু’দিনের মধ্যেই গুলি করে হত্যা করেন টেক্সাসের এক নাইট ক্লাবের মালিক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ওই দিন ভোরে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর বিপথগামী সদস্যরা তাকে তাঁর ধানমণ্ডি ৩২ এর বাসভবনে আক্রমণ করেন। বাঙ্গালি জাতির জনককে মোট ১৮টি গুলি করা হয়েছিল। হত্যা করা হয়েছিল তাঁর স্ত্রী, ভাই এবং দুই পুত্রবধূকেও। তবে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী), শেখ রেহেনা দেশের বাহিরে থাকায় বেঁচে যান। ঘটনার প্রায় ৩৫ বছর পর ২০১০ সালে সেই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িতদের মৃত্যুদন্ড হয়।
ইন্দিরা গান্ধী :
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীকে হত্যা করেন তাঁরই দুই দেহরক্ষী সতবন্ত সিংহ এবং বিয়ন্ত সিংহ। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর সকাল ৯টা ২০ মিনিটে তাঁর সফদরজং রোডের বাসভবনের বাগানে হাঁটছিলেন ইন্দিরা। বাড়ি থেকে এক ব্রিটিশ সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিতে তাঁর আকবর রোডের অফিসে যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। ঠিক সেই সময়েই তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালান তাঁর রক্ষীরা। ইন্দিরার হত্যার মাস খানেক আগেই পঞ্জাবের স্বর্ণমন্দিরে অপারেশন ব্লু স্টার চালিয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। এ ঘটনা শিখদের মধ্যে ইন্দিরাকে নিয়ে অসন্তোষ তৈরি করে বলে অভিযোগ। যার জেরেই তাঁকে হত্যা করা হয় বলেও অনুমান।
রাজীব গান্ধী :
রাজীব গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত। তাঁকে হত্যা করা হয় ১৯৯১ সালের ২১ মে। রাজীব তখন ভোটের প্রচারে দক্ষিণ ভারতে। তামিলনাড়ুর শ্রীপেরুমবুদুরে একটি জনসভা ছিল। সভাস্থলে পৌঁছে বুলেটপ্রুফ গাড়ি থেকে নেমে ডায়াসের দিকে এগোচ্ছিলেন রাজীব। একের পর এক শুভার্থীরা মালা পরিয়ে দিচ্ছিলেন তাঁকে। তাঁর হত্যাকারী তেনমোজি রাজারত্নমও এগিয়ে আসেন তাঁর দিকে। শুভেচ্ছা জানিয়ে পা ছোঁওয়ার পরই কোমরে বাঁধা আরডিএক্স বেল্টে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটান। ঠিক ১০টা বেজে ১০ মিনিটে। রাজীবকে হত্যার ঘটনার নেপথ্যে তামিল উগ্রপন্থী সংস্থা এলটিটিই-র ভূমিকা রয়েছে বলেও জানান গোয়েন্দারা।
বেনজির ভুট্টো
পাকিস্তানের প্রথম এবং একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো। ১৯৮৮ এবং ১৯৯৩ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। মাঝে প্রায় ন’বছর আড়ালে থেকে আবার ২০০৭ সালে দেশে ফেরেন ভুট্টো। ঠিক করেন নির্বাচনে লড়বেন। প্রচারও শুরু করে দেন। কিন্তু ভোটের ঠিক দু’সপ্তাহ আগে ২৭ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে একটি জনসভায় বক্তৃতা দিয়ে তার বুলেটপ্রুফ গাড়ির কাচ সরিয়ে হাত নাড়ছিলেন ভুট্টো। এক যুবক তাঁকে লক্ষ্য করে প্রথমে তিনটি গুলি করে। তারপর আত্মঘাতী বিস্ফোরণও ঘটায়।
বিএনএনিউজ/এইচ.এম।