বিএনএ,চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের নির্মাণাধীন একটি চার তলার ভবন থেকেই লাফ দিয়ে পালিয়েছে হাজতি ফরহাদ হোসেন রুবেল। নির্মাণাধীন চার তলার ভবনের উচ্চতা প্রায় ৬০ ফুট। তবে ৬০ ফুট উপর থেকে লাফ দিয়েও পা ভাঙেনি রুবেলের। এক্স-রে করার পর পুলিশ এ তথ্যটি জেনেছে।
মঙ্গলবার (৯ মার্চ) সকালে রুবেলকে নরসিংদী থেকে গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রামে নিয়ে আসার পর সন্ধ্যায় কোতোয়ালী থানায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (দক্ষিণ) পলাশ কান্তি নাথ। এরপর সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে রুবেলকে আদালতে হাজির করা হলে শুনানি শেষে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম হোসেন মোহাম্মদ রেজা।
জানা যায়, রুবেলকে নরসিংদী থেকে গ্রেপ্তারের পর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তাকে চট্টগ্রামে আনা হয়। তাকে প্রথমেই নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) উপ-কমিশনারের (দক্ষিণ) কার্যালয়ে। সেখানে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ৪টা ২০ মিনিটের দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে তার ক্ষত পায়ে প্ল্যাস্টার করার পর সন্ধ্যায় কোতোয়ালী থানায় মিডিয়ার সামনে হাজির করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত উপকমিশনার (দক্ষিণ) পলাশ কান্তি নাথ বলেন, হাজতি রুবেল কারাগারের কর্ণফুলী ভবনের ৫ তলার একটি ফ্লোরে থাকতেন। গত ৬ মার্চ ভোর ৫টা ১৫ মিনিটে ওই ভবন থেকে নিচে নামেন রুবেল। সেখানে একটা পানির হাউস থেকে তিনি চোখে মুখে পানি দেন। এরপর ডান পাশের গেট দিয়ে বেরিয়ে ওই ভবন থেকে আনুমানিক ১৫০ থেকে ২০০ গজ দূরে একটি নিমার্ণাধীন ভবনের চারতলায় উঠেন রুবেল। ৫টা ৩০ মিনিটের সময় চারতলা থেকে লাফ দিয়ে কারাগারের নিরাপত্তা প্রাচীর টপকে লাফিয়ে পড়েন তিনি। এরপর শনিবার সকাল ১০টা নাগাদ চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনযোগে প্রথমে ঢাকা ও পরে হয়ে নরসিংদীতে ফুফুর বাড়িতে যায় রুবেল।
পলাশ কান্তি নাথ বলেন, অন্যদিকে রুবেলের উধাও হওয়ার ব্যাপারটি জানার পর কমিশনার স্যারের তত্ত্বাবধানে আমরা পাঁচটি টিম গঠন করি। এরপর গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ করে আজ সকাল ৯টার দিকে রুবেলকে নরসিংদী থানাধীন রায়পুরার তার ফুফুর বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হই।
তিনি বলেন, রুবেলের চারতলা থেকে লাফ দেয়ার বিষয়টি আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। কিন্তু এখানে সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ব্যাপারটি সত্যি। ভাঙা পা নিয়ে কিভাবে তিনি নরসিংদী গেলেন সেটা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তদন্তের প্রয়োজনে এখন কিছু বিষয় আমরা গোপন রাখছি। পরবর্তীতে বিস্তারিত জানানো হবে।
অতিরিক্ত উপকমিশনার পলাশ কান্তি বলেন, এক্সরে করে দেখেছি, রুবেলের পা ভাঙেনি। সে আগেও এরকম দুর্ধর্ষ কিছু কাজ করতো, অভ্যাসগত ছিনতাইকারী। তার আগে থেকে চারটি মামলা ছিল। শারীরিকভাবে রুবেল খুবই সক্ষম। তার মানসিক শক্তিও বেশি। শারীরিক সক্ষমতার কারণে তাকে অন্যরা ভয় পায়, তার হাতে সবসময় চাকু থাকে।
এ বিষয়ে কোতোয়ালি থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নেজাম উদ্দীন বলেন, রুবেলকে আদালতে হাজির করা হলে শুনানি শেষে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় তার বিরুদ্ধে রিমান্ডের আবেদন করা হয় নাই।সুস্থ হলে রিমাণ্ড আবেদন করা হবে।
তিনি বলেন, রুবেলের বিরুদ্ধে কোতোয়ালীতে একটি, ডবলমুরিং থানায় দুটি ও সদরঘাটে তিনটি মামলা রয়েছে।
প্রসঙ্গত, শনিবার (৬ মার্চ) সকালে কারাগার থেকে নিখোঁজ হওয়া হাজতি রুবেলের হদিস পাওয়া যায়নি বলে জানায় কারা কর্তৃপক্ষ। কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে রুবেল কী পালিয়ে গেল, নাকি তাকে ঘিরে কারা অভ্যন্তরে অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটেছে, তা নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারেননি। উদ্ভূত এমন পরিস্থিতির মধ্যে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।
এদিকে কারাগার থেকে হাজতি রুবেল নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে জেলার মো. রফিকুল ইসলামসহ এক ডেপুটি জেলারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়া কর্ণফুলী ভবনের ১৫ নম্বর সেলের দায়িত্বরত কারারক্ষী নাজিম উদ্দিন ও সহকারী কারারক্ষী ইউনুস মিয়া সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। সহকারী প্রধান কারারক্ষী কামাল হায়দারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে।
কারা সূত্র জানা যায়, নিখোঁজের দুইদিন আগে ৪ মার্চ অন্য বন্দির সাথে মারামারিতে লিপ্ত হয় রুবেল। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে রুবেলকে শাস্তি হিসাবে কর্ণফুলী ভবনের ১৫ নম্বর ‘পানিশমেন্ট ওয়ার্ড’ এ ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে রাখা হয়েছিল।
এদিকে শনিবার (৬ মার্চ) ভোর থেকে হাজতি রুবেলের সন্ধান না মেলায় দিনভর তল্লাশি করে সন্ধ্যায় জিডির পর রাতে মামলা করেন প্রত্যাহার হওয়া জেলার রফিকুল ইসলাম। কোতোয়ালী থানার মামলা নম্বর ২৩/২১। ধারা-দণ্ডবিধির ২২৪।
মামলার এজহারে তিনি উল্লেখ করেন, শনিবার (৬ মার্চ) ভোর ৬টা থেকে তালামুক্ত করার পর ফরহাদ হোসেন ওরফে রুবেল নামে এক হাজতিকে পাওয়া যাচ্ছে না। যার হাজতি নম্বর ২৫৪৭/২১। তিনি গত ৯ ফেব্রুয়ারি সদরঘাট থানার একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আসেন। তার গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানায়। আগের দিন শুক্রবার রাতে সবার সাথে রুবেলও কারাগারের কর্ণফুলী ভবনের ৫ম তলার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে থাকলেও ভোর সাড়ে ৬টার পর থেকে তার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। পরে দায়িত্বরত কারারক্ষী ও হাজতিদের কাছ থেকে জানতে পারেন, হাজতি রুবেল শনিবার ভোর ৫টা ১৫ মিনিটে ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে যান। পরবর্তীতে পুরো কারাগারে তল্লাশি করেও তার হদিস মেলেনি।
এর আগে শনিবার দিনভর কারা অভ্যন্তরে তল্লাশি করেও হদিস না পেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে কারা কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. শফিকুল ইসলাম খান কোতোয়ালী থানায় জিডি করেন। জিডি নম্বর-৪১৭।
জিডিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সদরঘাট থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অর্ন্তবর্তীকালীন হাজতের পরোয়ানা মোতাবেক গত ৯ ফেব্রুয়ারি রুবেলকে কারাগারে পাঠানো হয়। শনিবার সকাল ৬টা থেকে কারা অভ্যন্তরে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। তার সন্ধানে কারা অভ্যন্তরে তল্লাশি চলছে।
জানা যায়, এর আগে ২০১৮ সালে নরসিংদীর রায়পুরার ফরহাদ হোসেন রুবেল কারাগারে গেলে সেই সময় দুইবার কারাগারের ড্রেনে ও ছাদে আত্মগোপন করেন। সেই সময় ব্যাপক খোঁজাখুঁজির পর দুইবারই তাকে উদ্ধার করে কারা কর্তৃপক্ষ। এবারও তিনি সেই কাজ করেছেন ধারণা করে কারা কর্মকর্তারা আশা করেন রাতের মধ্যেই কারাগারের ভেতর থেকে তার সন্ধান মিলবে।
রুবেল সদরঘাট থানার এসআরবি রেল গেইট এলাকায় ৫ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে তুচ্ছ ঘটনায় আবুল কালাম আবু নামের এক ভাঙারি ব্যবসায়ীকে বুকে ছুরিকাঘাত করেন। পরদিন সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কালাম হাসপাতালে মারা যান। ৬ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে হত্যার অভিযোগে ডবলমুরিং থানার মিস্ত্রি পাড়া থেকে ফরহাদ হোসেন রুবেলকে গ্রেপ্তার করে সদরঘাট থানা পুলিশ। ওই মামলায় ৯ ফেব্রুয়ারি আদালতের মাধ্যমে কারাগারে যান রুবেল।
বিএনএনিউজ/মনির