।। বাবর মুনাফ ।।
দেশীয় তৈরি চোলাই মদের অন্যতম ট্রানজিট চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলা। দেশীয় তৈরি মদের পাশাপাশি ইয়াবা এবং গাঁজাও দেদারসে বিক্রি হচ্ছে এ উপজেলায়। হাত বাড়ালেই মিলছে মাদক। ফলে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে মাদকাসক্তের সংখ্যা। মাদকাসক্তের উৎপাতে অতিষ্ঠ এলাকার লোকজন। ঘটছে চুরি, ছিনতাইসহ সামাজিক অপরাধ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদক বিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখলেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না মাদক ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য। এসব অভিযানে মাদকসেবী, মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার ও মাদক উদ্ধারের কথা বলছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
প্রায় প্রতিদিনই বোয়ালখালীতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অভিযান চালিয়ে মদসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য জব্দ করে আসছে। এসময় মাদক সেবনকারীদের আটক করতে সক্ষম হলেও গডফাদাররা রয়েছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
জানা গেছে, রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলার বাঙ্গালহালিয়া, বান্দরবান ও রাঙ্গুনিয়া থেকে পাহাড়ি পথে বোয়ালখালীতে আসে দৈনিক হাজার হাজার গ্যালন চোলাই মদ। মাদক ডিলাররাই এসব মদ কিনে আনেন। দূর্গম পাহাড়ি পথ বেয়ে প্লাস্টিকের বস্তায় ভারে করে বয়ে শ্রমিকরা এসব মদ নিয়ে আসেন। এরপর ভোর বা সন্ধ্যায় বোয়ালখালী উপজেলার জৈষ্ঠ্যপুরা গুচ্ছগ্রাম সড়ক, আমুচিয়ার সূর্যব্রত বিল ও করলডেঙ্গা দিয়ে লোকালয়ে পৌঁছে। খুচরা বিক্রেতারা সড়ক ও নদী পথে এসব মদ দক্ষিণ এবং উত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় নিয়ে যায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব মাদক পাচারে ট্রানজিট হিসেবে বোয়ালখালীকে ব্যবহার করেন মাদক ডিলাররা। এজন্য স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করেন মাসোহারা দিয়ে। খুচরা বিক্রেতারাও মাসোহারা দিয়ে সন্ধ্যার পর মদ বিক্রি করছেন উপজেলার বিভিন্ন স্থানে। এ সেবককারীর তালিকায় যোগ হয়েছে শিশু, কিশোরসহ বিভিন্ন তরুণরা। যা উদ্বেগজনক। এ ব্যাপারে সামাজিক প্রতিরোধ ও সচেতনতা সৃষ্টি করা না হলে এ সমস্যা মহামারিতে রূপ নেবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চোলাই মদের পাশাপাশি বোয়ালখালীতে গত এক দশক ধরে ইয়াবার বিস্তার ঘটেছে। মাদক বিরোধী অভিযানে প্রায় সময় চোলাই মদের চালান ধরা পড়লেও ইয়াবা উদ্ধারের উল্লেখযোগ্য তথ্য তেমন নেই। কক্সবাজার জেলা থেকে পটিয়া হয়ে একাধিক সড়ক পথে এসব ইয়াবার চালান বোয়ালখালীতে ঢুকে। তবে গুটি কয়েক অভিযানে ইয়াবা সেবী এবং হাতে গোনা ইয়াবা উদ্ধারের তথ্য রয়েছে পুলিশের খাতায়। একইভাবে আরেক মাদক গাঁজারও।
একাধিক সূত্র বলছে, উপজেলার করলডেঙ্গা ইউনিয়নের তালুকদার পাড়ার সাদেক, ম্যারা সাইফুল, সুমন, পটিয়ার রতনপুরের এস আলম, সারোয়াতলী লালার হাটের সাইফু, খিতাপচরের আবছার, উত্তর কঞ্জুরীর আকবর হোসেন বুলবুল, ইমামুল্লারচরের আক্তার, ইমাম নগরের রুবেল, মাসুদ, সহিদ, শিবু, আকতার, জৈষ্ঠ্যপুরার ফারুক, সুব্রত, প্রদীপসহ আরও কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ডিলার। এদের বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা। গ্রেপ্তারও হয়েছেন বেশ কয়েকবার।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, উপজেলার পশ্চিম শাকপুরা, খিতাপচর, কঞ্জুরী, খরণদ্বীপ, চরণদ্বীপ, কধুরখীল, পূর্ব গোমদণ্ডী ও পশ্চিম গোমদণ্ডীতে সন্ধ্যার পর থেকে বিক্রি হয় মাদক। এসব স্পটের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে থানার সোর্সরা মাসোহারা আদায় করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। মাসোহারা না দিলে অভিযান চালিয়ে দেখানো হয় মাদক নির্মূলের তৎপরতা।
গত দুই মাসের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছরের ১৩ নভেম্বর আমুচিয়া ইউনিয়নের কানুনগোপাড়া থেকে ৩০০ লিটার চোলাই মদসহ গ্রেপ্তার হন নুর বক্স। ১৭ নভেম্বরে একই ইউনিয়ন থেকে ১৫০ লিটার চোলাই মদসহ গ্রেপ্তার করা হয় মিঠুন সর্দারকে। ১৮ নভেম্বর কধুরখীল জমাদার ঘাটা এলাকা থেকে ৩০০ লিটার মদসহ গ্রেপ্তার হন নাজিম উদ্দিন নেজাম। ২৩ নভেম্বর ৫ লিটার মদসহ মো. মহিউদ্দীনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৪ ডিসেম্বর করলডেঙ্গা থেকে ৫০০ লিটার মদসহ গ্রেপ্তার করা হয় নাছির উদ্দীন সুজনকে। ২১ ডিসেম্বর সারোয়াতলীর উত্তর কঞ্জুরী গ্রাম থেকে ৭০০ লিটার মদসহ গ্রেপ্তার হন রিমন দাস। ৭ জানুয়ারি ৫০০ লিটার দেশি মদ, ১০০ গ্রাম গাঁজা, স্বর্ণালংকার এবং ২ লক্ষ ২৮ হাজার ৮ শত ৮০ টাকাসহ গ্রেপ্তার হন নারী মাদক বিক্রেতা চৈতি দে ও মাদকসেবী শফিকুল ইসলাম।
গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য মদ উদ্ধার:
২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর বোয়ালখালী উপজেলার করলডেঙ্গা গুচ্ছগ্রাম এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছিলো ২ হাজার লিটার চোলাই মদ। এর পরের বছর ২৯ সেপ্টেম্বর একই ইউনিয়নে পাহাড়ে মিলেছিল ১৮ বস্তা মদ। তারপরের বছর ২০১৭ সালে ২৮ আগস্ট জৈষ্ঠ্যপুরা সূর্যব্রত বিলের পাহাড়ি এলাকা থেকে ১৯০ লিটার মদ উদ্ধার করা হয়। ২০১৮ সালের ৩ মার্চ করলডেঙ্গায় অভিযান চালিয়ে ১ হাজার লিটার মদ উদ্ধার করে থানা পুলিশ। একই বছরের ২৭ জুলাই পশ্চিম গোমদণ্ডীর একটি খালে থাকা ইঞ্জিন চালিত নৌকা থেকে কোস্টগার্ড ও পুলিশ যৌথ অভিযানে ২ হাজার লিটার মদ উদ্ধার করে। এসব মদ উদ্ধারের সময় হাতেনাতে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেননি পুলিশ। তবে মামলা দায়ের করেছিলো পুলিশ। এরপর ২০২১ সালের ৬ জুলাই ৯৫০ লিটার চোলাই মদসহ গ্রেপ্তার হন শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ইউনিয়নের সূত্রধর পাড়ার শ্রীধাম চৌধুরী ও রূপন সূত্রধর।
এ উপজেলায় ২০২১ সালের ১৬ মে পূর্ব চরণদ্বীপে এলাকাবাসীর হাতে ধরা পড়েছিলো এ যাবৎকালের বৃহৎ গাঁজার চালান। সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ২২ কেজি গাঁজাসহ ধরা পড়েছিলো রমজান হোসেন ও আজিম উদ্দিন নামের দুই মাদক ব্যবসায়ী। এরপর ২০২১ সালের ৬ জুলাই ২ কেজি গাঁজাসহ পোপাদিয়ায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মো. শহিদুল্লাহ সাইয়্যা। গত ২০২৩ সালের ১২ অক্টোবর শাকপুরায় ১০০ গ্রাম গাঁজাসহ আবুল কালাম প্রকাশ মাছ কালামকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ।
গত সোমবার (৬ জানুয়ারি) রাত দেড়টার দিকে পৌরসভার গোমদন্ডী ফুলতল মোড় থেকে নেজাম উদ্দিন বাদশা (২৩) ও মো. আবু বক্কর প্রকাশ হিরন (৪৫) নামের দুই ব্যক্তিকে ৬ লিটার চোলাই মদ এবং ২৭ গ্রাম গাঁজাসহ গ্রেপ্তার করে যৌথবাহিনী।
বোয়ালখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম সরোয়ার বিএনএ নিউজকে বলেন, নিয়মিত মাদক বিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। মাদক ব্যবসায়ীদের তথ্য সংগ্রহ করছি।
তিনি আরও বলেন, মাদক নির্মূলে সামাজিকভাবেও সকলকে মাদকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে পুলিশকে সহায়তা করার জন্য সকলকে অনুরোধ জানান।
বিএনএনিউজ/ শাম্মী