বিএনএ, ঢাকা: চট্টগ্রামবাসীর বহুল প্রতীক্ষিত কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর উপর রেল–কাম সড়ক সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি অবশেষে একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সোমবার (৭ অক্টোবর) অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ১১ হাজার ৫৬০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়।
কালুরঘাট সেতু একনেকে অনুমোদন হওয়ার পর সেতু নির্মাণের জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ শুরু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এরই অংশ হিসেবে কনসালটেন্ট নিয়োগ, ডিটেইল ডিজাইন তৈরির কাজ শুরু হওয়ার কথা জানালেন রেলওয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা। ডিটেইল ডিজাইন করতে এক বছরের মতো লাগবে। এরপর সেতু নির্মাণের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হবে। আনুষঙ্গিক যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষ করে সেতুর কাজ ২০২৬ সালের মাঝামাঝি শুরু হবে। তবে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ আগামী ৬ মাসের মধ্যে শুরু হবে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক প্রকৌশলী।
সোমবার প্রধান উপদেষ্টা এবং একনেক চেয়ারপারসন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় তেজগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় এ প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে বিকালে শেরে বাংলানগর এনইসি সম্মেলন কেন্দ্রে সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দীন মাহমুদ এ বিষয়ে বিস্তারিত জানান।
প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন হওয়ায় এখন সেতু নির্মাণের পরবর্তী পদক্ষেপ শুরু করবেন বলে জানান রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী। তিনি বলেন, এখন ধাপে ধাপে আমরা সেতু নির্মাণের সকল কার্যক্রম শুরু করব। প্রকল্পের ১১ হাজার ৫৬০ কোটি ৭৭ লাখ টাকার মধ্যে ৪ হাজার ৪৩৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা বাংলাদেশ সরকারের। বাকি ৭ হাজার ১২৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা দেবে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগিতা তহবিল (ইডিসিএফ) এবং ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট প্রমোশন ফ্যাসিলিটি (ইডিপিএফ)।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারের মধ্যে নির্বিঘ্ন ও নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বর্তমান পুরাতন সেতুর পাশে কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর উপর নতুন রেল–কাম সড়ক সেতু নির্মাণ করতে যাচ্ছে সরকার। রেলপথ মন্ত্রণালয় ২০৩০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।
মূল প্রকল্পের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ৭০০ মিটার রেল–কাম রোড ব্রিজ নির্মাণ, ৬ দশমিক ২০ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট নির্মাণ, ২ দশমিক ৪০ কিলোমিটার সড়ক ভায়াডাক্ট, ৪ দশমিক ৫৪ কিলোমিটার বাঁধ, ১১ দশমিক ৪৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ এবং আনুষাঙ্গিক কাজ।
কালুরঘাট সেতু নির্মাণ–সংক্রান্ত ফোকাল পার্সন ও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, এখন আমরা কনসালটেন্ট নিয়োগ করব। ডিটেইল ডিজাইন হবে। ডিটেইল ডিজাইন করতে এক বছর লাগবে। তারপর টেন্ডার আহ্বান করা হবে। এরপর সেতুর কাজ শুরু হবে। সেতুর কাজ ২০২৬ সালের মাঝামাঝি শুরু হবে জানিয়ে তিনি বলেন, কনসালটেন্ট নিয়োগের সাথে সাথে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হবে। আগামী ৬ মাসের মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হবে বলে জানান তিনি।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটি ২০১৮ সালে ১ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণের জন্য প্রস্তাব করে রেলপথ মন্ত্রণালয়। তখন একনেক থেকে প্রকল্পটি ফেরত পাঠানো হয়। পরে নতুন নকশায় সেতুর নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স বেড়ে যাওয়ায় প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, যা আগের প্রকল্পের জন্য প্রস্তাবিত ব্যয়ের ১০ গুণের বেশি।
প্রকল্পের ডিপিপি সূত্রে জানা গেছে, কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপর নতুন একটি রেল সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় সরকারি অর্থায়নে ২০১২ সালে এসএমইসি ও ডব্লিউআইইসিওএন কোং লিমিটেড এবং বাংলাদেশের এসিই কনসালটেন্ট লিমিটেড ও ইঞ্জিনিয়ার কনসোর্টিয়াম লিমিটেড যৌথভাবে প্রস্তাবিত প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন করে। সরকার সেতু নির্মাণে দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তার অনুরোধ জানালে ইডিসিএফের নিয়োজিত পরামর্শক আগের ফিজিবিলিটির ভিত্তিতে নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স ৭ দশমিক ৬২ মিটার বিবেচনা নিয়ে ২০১৬ সালে পুনরায় প্রকল্পের ফিজিবিলিটি সম্পন্ন করে।
এ ফিজিবিলিটি স্টাডির আলোকে রেল–কাম সড়ক সেতু নির্মাণের জন্য প্রণীত প্রকল্পের ডিপিপি ২০১৮ সালের ৭ আগস্ট অনুষ্ঠিত একনেক সভায় উপস্থাপন করা হয়। তখন সেতুটি পদ্মা সেতুর আদলে দ্বিতল নকশা করায় প্রকল্পটি অনুমোদন না দিয়ে সভায় নির্দেশনা দেওয়া হয়, প্রস্তাবিত সেতুর সড়ক ও রেল সেতুর জন্য আলাদা ডিজাইন প্রণয়ন করে পুনরায় একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য।
এ নির্দেশনা এবং পরে ২০১৯ সালে বিআইডব্লিউটিএ কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট পয়েন্টে রেল–কাম রোড সেতুর নির্মাণে নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স ১২ দশমিক ২ মিটার রাখার জন্য রেল মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাব দেয়। এ নিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের যৌথ সভা হয়। শেষ পর্যন্ত নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স ৭ দশমিক ৬২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২ দশমিক ২ মিটার করার সিদ্ধান্ত হয়। নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স ১২ দশমিক ২ মিটার রেখে নতুনভাবে ফিজিবিলিটি স্টাডি করার জন্য ইডিসিএফের পক্ষ থেকে ২০২১ সালের ২২ অক্টোবর উশিন অ্যান্ড দোহা ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন জেভির সঙ্গে পরামর্শক চুক্তি সই করা হয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ২০২৩ সালের মে মাসে চূড়ান্ত ফিজিবিলিটি স্টাডি দাখিল করে। ওই ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্টের ভিত্তিতে কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর উপর রেলওয়ের ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন এবং দুই লেনবিশিষ্ট সড়কপথের সুবিধা রেখে রেল–কাম রোড সেতু নির্মাণের ডিপিপি প্রণয়ন করে। এতে প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয় ১১ হাজার ৫৬৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্সের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় এতে সেতুর উচ্চতাসহ ভায়াডাক্টের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। যার কারণে প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
পরিকল্পনা কমিশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে নির্বিঘ্ন ও নিরবচ্ছিন্ন রেল যোগাযোগ নিশ্চিত করা এবং ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে সংযোগের সুযোগ তৈরি করা। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে পুরনো কালুরঘাট সেতু দিয়ে ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে ট্রেন চলাচল করতে পারে না। এছাড়া মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর চালু হলে এ অঞ্চলে ব্যবসা–বাণিজ্য যেমন চাঙ্গা হবে, তেমনি এ রুটের গুরুত্বও বাড়বে। ইতোমধ্যে দোহাজারী–কক্সবাজার রেললাইন চালুর মাধ্যমে ঢাকা ও কক্সবাজারের মধ্যে সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। ফলে পর্যটন নগরীর সঙ্গে নির্বিঘ্নে যোগাযোগ নিশ্চিত করতে পুরাতন সেতুর পাশে নতুন রেল–কাম সড়ক সেতু নির্মাণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
বর্তমানে দেশের আমদানি–রপ্তানি কার্যক্রমের ৭০ শতাংশ হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। প্রকল্পটি চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে নির্বিঘ্ন রেল যোগাযোগ এবং পণ্য পরিবহন নিশ্চিত করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এদিকে, কালুরঘাট রেল–কাম সড়ক সেতু নির্মাণ প্রকল্প একনেকে পাস হওয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে বোয়ালখালী–কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদ, বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি এবং বোয়ালখালী প্রেস ক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
বিএনএনিউজ/ বাবর মুনাফ/এইচমুন্নী