।। শামীমা চৌধুরী শাম্মী।।
বিএনএ, ঢাকা : দেশের পার্বত্য জেলা বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলায় দুই দিনে তিন ব্যাংকে হামলা করে ১৪ লাখ টাকা এবং ১৪টি অস্ত্র লুট করেছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট। সেই সঙ্গে অপহরণ করা হয়েছিল রুমা উপজেলা সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার নিজাম উদ্দিনকে। সেনাবাহিনীর সহায়তায় র্যাব ব্যাংক ম্যানেজারকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করতে সমর্থ হয়। যা প্রসংসার দাবি রাখে।
সার্বিক পরিস্থিতিতে বান্দরবানে এক ধরনের যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। এতে সেখানে বসবাসরত আদিবাসী ও বাঙালি জনগোষ্ঠী উভয়েই আতঙ্ক ও ভয়ের মধ্যে আছে। পাশাপাশি পর্যটন ব্যবসায় এক ধরনের ধস নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হিসেবে মনে করে। তবে কেএনএফ তাদের অনলাইন প্ল্যাটফরমে দাবি করেছে, তারা বাংলাদেশের কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন নয়। তারা বলছে, তারা ‘সুবিধা বঞ্চিত কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর জন্য স্বশাসিত বা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতাসহ একটি ছোট রাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবি করছে, স্বাধীনতার ঘোষণা তারা দেয়নি।’
ইতিমধ্যে কেএনএফ তাদের তিনটি দাবির কথা জোরালোভাবে বলছে। রুমা, থানচি, রোয়াংছড়িসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের নয়টি উপজেলা নিয়ে ‘স্বায়ত্তশাসিত’ অঞ্চল গঠন। ওই এলাকায় কুকি-চিনের নেতৃত্বে পৃথক প্রশাসনিক অঞ্চল এবং ভারত ও মিয়ানমারে চলে যাওয়া কুকি-চিন জনগোষ্ঠীকে ফেরত আনার ব্যবস্থা করা। এসব দাবি উঠার সঙ্গে সঙ্গে কেএনএফকে নির্মূল করার জন্য দেশের নিরাপত্তা বাহিনী জোরালো অভিযান শুরু করে।
পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ ও স্থানীয়দের নিয়ে একটি শান্তি কমিটি করা হয়। সে শান্তি কমিটির মাধ্যমে কেএনএফের শান্তি আলোচনা চলমান রয়েছে। এমনকি শান্তি কমিটির সঙ্গে কেএনএফের পরবর্তী বৈঠক ২২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে পরপর ব্যাংকে ডাকাতি, অপহরণ, বাজারে গোলাগুলি নানা প্রশ্ন তৈরি করছে। প্রশ্ন উঠছে, কেএনএফ কি ফান্ড সংকট কাটানোর জন্য ব্যাংক ডাকাতির পথ বেছে নিয়েছ?
ভূরাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন কেএনএফ শুধু টাকার জন্য ব্যাংক ডাকাতি করেনি। কারণ তারা দুটি ব্যাংকের তিনটি ব্রাঞ্চ ডাকাতি করে ১৪ লাখের মাত্র কিছু বেশি অর্থ হাতিয়ে নিতে পেরেছে। তাহলে কি অস্ত্র লুটই উদ্দেশ্য ছিল?
পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্তে এখন মিয়ানমার পরিস্থিতির কারণে বিচ্ছিন্নবাদীরা অস্ত্র সংকটে আছে সেটা মনে করেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তবে একটি বিষয় পরিস্কার কেএনএফ শান্তি আলোচনায় আরও দর কষাকষির জন্য তাদের শক্তির জানান দিতে চেয়েছে। কেএনএফ মূলত এটা দেখাতে চাচ্ছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর শক্তিশালী অবস্থানকে তারা চ্যালেঞ্জ করে দিতে পারে।
দেশের সীমান্তের বাহিরে তারা একটি শক্ত ঘাঁটি তৈরি করেছে। কেএনএফের ফেসবুক পেজ ও ইউটিউবে পোস্ট করা ভিডিওগুলোতে যেসব সামরিক ট্রেনিংসহ কার্যক্রম দেখানো হয়, তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরের কোনো ছবি বা ভিডিও নয় বলেই মনে করছে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। পার্বত্য চট্টগ্রামে দায়িত্বরত সামরিক গোয়েন্দারা মনে করেন, নাথান বম বাংলাদেশের সীমান্তের বাহিরে অবস্থান করেন। কর্মকর্তাদের ধারণা, ভারতের মিজোরামে নাথান বম-এর অবস্থান রয়েছে।
সাদা চোখে এটি শুধু ডাকাতি বা অস্ত্র লুটের ঘটনা মনে হলেও নেপথ্যে রয়েছে ভূরাজনীতির নতুন মেরুকরণ। সদ্য আলোচনায় আসা সশস্ত্র সংগঠনটির শিকড় অনেক দূরে অর্থাৎ দেশের বাহিরে। মিয়ানমার সরকারের কাছে আরাকান আর্মির দাবি ও কেএনএফের দাবির মধ্যে কিছুটা মিল আছে। দুটি সংগঠনই স্বায়ত্তশাসনের দাবি করছে এবং স্বাধীনতার দাবি অস্বীকার করছে। সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মির সফলতা ও মিয়ানমার সীমান্তে অস্ত্রের সহজলভ্যতায় কেএনএফ নিজেদের জানান দিতে উৎসাহিত হয়েছে।
ভারতের মণিপুরের পরিস্থিতি ও মিয়ানমারের আরাকানের পরিস্থিতি সব মিলিয়ে এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনা বিরাজ করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গে ভারত ও মিয়ানমার অংশের সীমান্তে ঘন জঙ্গল অপরাধীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। ফলে কেএনএফকে নিরাপত্তা বাহিনীর কয়টি অভিযানে নির্মূল করা যাবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না ।
কুকি-চিনকে খুব একটা হালকা করে দেখার যেমন সুযোগ নেই তেমনি তাদের বেশি সুযোগ দেওয়াও হবে বোকামি। কুকি-চিনের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা ইউপিডিএফের বিরোধ রয়েছে। তবুও কুকি-চিনের বিশেষ অর্জন এসব সংগঠনকে উৎসাহিত করবে। পার্বত্য এলাকায় শান্তি ও শৃঙ্খলার স্বার্থে কুকি- চিনকে এখানেই থামিয়ে দিতে হবে এমনটাই মনে করেন ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিএনএনিউজ/এইচ.এম।