।। শামীমা চৌধুরী শাম্মী ।।
বিএনএ, ঢাকা: মিয়ানমার হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সেই দেশ, যেই দেশে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে সামরিক বাহিনীর শাসন চলছে। ব্রিটেনের কাছ থেকে এক সময় বার্মা নামে পরিচিত দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৮ সালে। আর এরপর থেকে মিয়ানমারের গত ৭৬ বছরের ইতিহাসে সামরিক শাসন চলছে ৫৩ বছরের বেশি সময় ধরে। দেশটির রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর যে বিশাল প্রভাব রয়েছে, সেটি বেশ অভাবনীয়।
মিয়ানমারে সেনাশাসন অনেক পুরনো এবং দীর্ঘস্থায়ী। এশিয়ার আরও অনেক দেশের মতো এটিও ছিল ব্রিটেনের শাসনাধীনে এবং ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশরা ক্ষমতা ছেড়ে চলে যায়। বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী এই দেশটিতে সামরিক বাহিনীর প্রভাব বেশি হওয়ার পেছনে অবশ্য ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। স্বাধীনতা লাভের ছয় বছর আগেই বার্মিজ সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বেও ছিল দেশটির সেনাবাহিনী। ফলে বার্মিজ সেনাবাহিনীর অফিসার এবং সৈনিকদের মধ্যে রাজনৈতিক মনোভাব শুরু থেকেই ছিল বলে তিনি মনে করেন।
বার্মার স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্বে দিয়েছিলেন জেনারেল অং সান, যাকে দেশটির সামরিক বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের ছয় মাস আগে প্রতিপক্ষের হাতে খুন হন অং সান। তবে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই বার্মার জনগণ সেনাবাহিনীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতো, তাদের মনে করা হতো দেশের রক্ষাকারী হিসেবে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দাবি করে যে, দেশটিকে ঐক্যবদ্ধভাবে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী ভূমিকা রেখেছে। নতুবা বার্মা ভেঙ্গে টুকরো-টুকরো হয়ে যেতো। বার্মার সামরিক বাহিনী তাতমডো নামে পরিচিত এবং এর মূল শাখা বাহিনী হলো সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনী। স্বাধীনতা লাভের পর বার্মায় একটি সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় উ নু’র নেতৃত্বে। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রধানমন্ত্রী উ নু সেনাবাহিনীকে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানান। জেনারেল নে উইন ছিলেন সেনাবাহিনীর কমান্ডার, আর তার নেতৃত্বে সরকার পরিচালিত হয় ১৯৫৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত।
১৯৬০ সালে বার্মায় একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনের পর উ নু’র নেতৃত্বে আবারও একটি বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ওই সরকারও চলমান অস্থিরতাগুলো সামাল দিতে ব্যর্থ হয়। ওই ব্যর্থতাকে পুঁজি করেই নির্বাচনের দুই বছরের মাথায় বার্মায় সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। সেই থেকে বিভিন্ন উপায়ে প্রায় ৫৩ বছর ধরেই চলছে বার্মায় সামরিক শাসন।
মিয়ানমারের সর্বশেষ সংবিধান অনুযায়ী, দেশটির সেনাপ্রধান নিজেই নিজের বস। অর্থাৎ তিনি কারও কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। ২০০৮ সালের ওই সংবিধানে মিয়ানমারের সংসদে এক-চতুর্থাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়। তবে শুধু আসন সংরক্ষিত রাখাই নয়, সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও সেনাবাহিনীর হাতে রয়েছে। এ তিনটি বিষয় হচ্ছে – স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সীমান্ত সংক্রান্ত বিষয়। মিয়ানমারে বর্তমানে যে সংবিধান রয়েছে, সেটি বেসামরিক সরকারের উপর সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে। দেশটির মোট জাতীয় বাজেটের ১৪ শতাংশ ব্যয় হয় সামরিক খাতে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বেসামরিক রাজনীতিবিদদের হাতে ক্ষমতা পুরোপুরি ছেড়ে দিতে মোটেও রাজী নয়। স্বাধীনতার পরে দেশের ভেতরে জাতিগত সংঘাত মোকাবেলার জন্য বার্মার সেনাবাহিনীর শক্তি বাড়ানো হয়। ফলে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী ধীরে ধীরে রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণ দৃঢ় করতে শুরু করে।
২০০১ সালে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৬২ সাল থেকেই মিয়ানমারের সামরিক জান্তারা আন্তর্জাতিক মহল থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করতে থাকে। তারা সবসময় এটাই মনে করতো যে মিয়ানমারের ভেতরে থাকা সম্পদ দিয়ে নিজ দেশের সমস্যার সমাধান করা যাবে। ফলে আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি নিয়ে সামরিক জান্তারা খুব একটা মাথা ঘামায়নি। একই সাথে মিয়ানমারের ভেতরে রাজনৈতিক শক্তি গড়ে উঠতে দেয়নি সেনাবাহিনী।
ভূ-রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, সেনাবাহিনীর ভেতরে এমন আশংকা রয়েছে যে রাজনীতি শক্তিশালী হলে সামরিক বাহিনীর প্রভাব কমে যাবে। সেজন্য যারাই সামরিক জান্তার বিরোধিতা করছে, তাদের শক্ত হাতে দমন করা হয়েছে। শক্তিশালী এক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মুখে বাধ্য হয়ে ১৯৯০ সালে সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করেছিল তৎকালীন সামরিক জান্তা। ওই নির্বাচনে অং সান সু চি-র নেতৃত্বে এনএলডি জয়ী হলেও তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি সামরিক জেনারেলরা।
২০১৫ সাল থেকে পাঁচ বছরের জন্য অং সান সু চি-র ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) একটি বেসামরিক সরকার গঠন করলেও সেনাবাহিনীর প্রভাব থেকে সেই সরকার বা রাষ্ট্রীয় কাঠামো বেরিয়ে আসতে পারেনি। ২০২১ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি সকালবেলায় মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। এই দিনে মিয়ানমারের পার্লামেন্টে অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। মিয়ানমারের তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সুচি, রাষ্ট্রপতি উইন মিন্টসহ অন্তত ২৪ জন মন্ত্রীকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠান। তখন থেকে দেশটিতে চলছে জেনারেল ‘মিন অং লাই’ এর শাসন।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অবস্থিত লোয়ি ইন্সটিটিউট-এর পূর্ব এশিয়া বিষয়ক গবেষক অ্যারন কনেলি ২০১৭ সালে সিএনএন-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনটা বলেছিলেন: “মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে যদি বলা হয়, দেশের ভেতরে নিয়ন্ত্রণ নাকি আন্তর্জাতিক সম্মান- তোমরা কোনটি চাও? তারা দেশ নিয়ন্ত্রণ করাটাকেই বেছে নেবে।”
বিএনএনিউজ/ বিএম/ হাসনা