20 C
আবহাওয়া
৬:১৩ পূর্বাহ্ণ - নভেম্বর ২৪, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » বঙ্গবন্ধুর অলিখিত ১০৯৫ শব্দ এখন বিশ্ব সম্পদ!

বঙ্গবন্ধুর অলিখিত ১০৯৫ শব্দ এখন বিশ্ব সম্পদ!

মিজানুর রহমান মজুমদার

।।মিজানুর রহমান মজুমদার।।

 

২০১৩ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী ৪১ জন ব্যক্তির বিখ্যাত ভাষণ নিয়ে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ডের ‘We Shall Fight on The Beaches : The Speeches That Inspired History’ বইটিতে  ১০৯৫টি বজ্রকঠিন শব্দে তৈরি ১৮ মিনিটের বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি স্থান পেয়েছে।বইটির বেশিরভাগ ভাষণই ছিল পূর্বপরিকল্পিত ও লিখিত।

জ্যাকব এফ ফিল্ডের  বইটিতে ১৮৬৩ সালের আব্রাহাম লিংকনের ‘গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস’, নামে ২৭২ শব্দের দুই মিনিটের লিখিত ভাষণটি ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষের সামনে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৬৩ সালের মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ অ্য ড্রিম’, নামের ১৬৬৬ শব্দের ১৭ মিনিটের লিখিত ভাষণটি প্রায় দুই লাখ মানুষের সামনে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৪০ সালের উইনস্টন চার্চিলের ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস’, নামে পরিচিত ৩৭৬৮ শব্দের ১২ মিনিটের ভাষণটি ৬০০ মানুষের সামনে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের জওহরলাল নেহেরুর ‘অ্যা ট্রাইস্ট উইথ ডেস্টিনি’, নামে পরিচিত ৭৫৫ শব্দের পাঁচ মিনিটের ভাষণটি ৫০০ মানুষের সামনে দেওয়া হয়েছিল।

 

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল অলিখিত এবং কোনো ধরনের পূর্ব প্রস্তুতিবিহীন। ১৮ মিনিটের এ ভাষণটি যখন বঙ্গবন্ধু দেন তখন তার সামনে ছিল ১০ লাখ মানুষ!  এই ভাষণটি পাল্টে দিয়েছিল তৎকালীন রাজনৈতিক দৃশ্যপট। সত্যিকার অর্থেই বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ খ্যাত বঙ্গবন্ধুর এই  ভাষণে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।

 

বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথাই বলেছেন। বলেছেন বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির কথা বলেছেন। তার বক্তৃতায় বাঙালি জাতির উপর তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাষকদের নির্যাতনের করুণ বর্ণনা দিয়েছেন। একই সাথে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বাঙালি জাতির গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি তুলেছেন।

 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণে শোষণমুক্ত সমাজতন্ত্রের প্রতিফলন দেখা যায়। তিনি একদিকে যেমন বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির দাবি জানিয়েছেন, তেমনি অসহযোগ আন্দোলনে শ্রমজীবী গরীব মানুষের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। সব শেষে বঙ্গবন্ধু তার ৭ই মার্চের ভাষণে ধর্মনিরপেক্ষতার সাক্ষর রেখেছেন। তিনি তার বাঙালি জাতীয়তাবাদ চেতনার প্রতিষ্ঠায় হিন্দু, মুসলমান, বাঙালি, অ-বাঙালি সবার কথাই বলেছেন।

 

১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা ৭ মার্চে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিরস্ত্র জাতিকে স্বাধীনতার জন‌্য অস্ত্র হাতে তুলে নিতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী এই ভাষণে ছিল স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতির পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা। সে ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালি জাতি ছিনিয়ে এনেছিল বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। পরাধীন জাতিকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে সেই জ্বালাময়ী বক্তৃতা। বঙ্গবন্ধুর মতো এমন আবেদনময় ও সুনিপুণ দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বঙ্গবন্ধু বজ্রকন্ঠে বলেছেন, ‘দাবায়া রাখতে পারবা না’। সত্যিই তো বাঙ্গালীকে দাবায়া রাখা যায়নি।

 

বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষণগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত করার অনেকগুলো কারণ আছে। প্রথমত এই ভাষণটি প্রচণ্ড মাত্রায় উদ্দীপনার ও প্রেরণাদায়ী। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। দৃপ্তকণ্ঠে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। … রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাআল্লাহ।’

 

পাকিস্তানি শাসন-শোষণ-নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা—‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ভাষণের অন্য একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সময়ের পরিসীমায় গণ্ডিবদ্ধ না থেকে তা হয় কালোত্তীর্ণ ও সব সময়ের জন্য প্রেরণাদায়ী।

 

সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণকে পঞ্চম তফসিল দ্বারা আমাদের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উপরন্তু সংবিধানের ৭(খ) অনুযায়ী সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদকে সংবিধানের একটি অ-পরিবর্তনযোগ্য বিধান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে পঞ্চম তফশিলে উল্লেখিত বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি আমাদের সংবিধানের একটি অপরিহার্য ও অপরিবর্তনীয় অংশে পরিণত হয়েছে।

 

দীর্ঘ ২১ বছর এদেশে বঙ্গবন্ধু এক ধরনের নিষিদ্ধ ছিলেন। রেডিও টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনা যেতো না, শোক দিবস পালন করা হতো না, এমনকি স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে তাকে মেনে নিতেও আমাদের দ্বিধা ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর থেকে ইতিহাসের পাতা থেকে আবার সসম্মানে বঙ্গবন্ধুকে তুলে আনা হয়েছে।

 

তারই ধারবাহিকতায় ২০১৭ সালের গত ৩০ অক্টোবর প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।  ১০৯৫টি বজ্রকঠিন শব্দে উচ্চারিত ১৮ মিনিটের এই ভাষণ পুরো পৃথিবীর কাছেই একটি মূল্যবান ও ঐতিহ্যপূর্ণ সম্পদে পরিণত হয়েছে।

Loading


শিরোনাম বিএনএ