মনির ফয়সাল
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা গৌরবের এক অনন্য দিন। ৫০ বছর আগের এ দিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে গর্জে উঠেছিল উত্তাল জনসমুদ্র। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বিকেলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্তাল জনসমুদ্রে ভাষণ দিয়েছিলেন। অগ্নিঝরা সেই দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহতী কাব্যের কবি হয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু। তার বজ্রকণ্ঠের নিনাদে বাংলার আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হলো স্বাধীনতার ঘোষণা। শ্বাসরুদ্ধকর সেই সময়ে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালিকে মুক্তি আর স্বাধীনতার মন্ত্র বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেছিলেন নির্ভয়চিত্তে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই বজ্রনির্ঘোষ মুক্তিমন্ত্র উচ্চারণের আজ ৫০ বছর পূর্তি। বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের মাহেন্দ্রক্ষণে।
‘একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য কি দারুণ অপেক্ষা আর উত্তেজনা নিয়ে/লক্ষ লক্ষ উন্মুক্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে/ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে/কখন আসবেন কবি?’/ …শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/…. কে রোধে তাঁহার বজ কণ্ঠ বাণী?/ গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি/এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।/ সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’ কবি নির্মলেন্দু গুণ অগ্নিঝরা একাত্তরের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণের মুহূর্তটি এভাবে কবিতায় মূর্ত করে তুলেছেন।
বঙ্গবন্ধু সেদিন শুধু স্বাধীনতার চূড়ান্ত আহ্বানটি দিয়েই চুপ থাকেননি, স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখাও দিয়েছিলেন। মূলত বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণই ছিল ৯ মাসব্যাপী বাংলার মুক্তি সংগ্রামের ঘোষণা ও মূল ভিত্তি। সেদিন বেলা ৩টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আরোহণ করেন। ফাগুনের সূর্য তখনও মাথার উপর। মঞ্চে আসার পর তিনি জনতার উদ্দেশে হাত নাড়েন। তখন পুরো রেসকোর্স ময়দান লাখ লাখ বাঙালির ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব-শেখ মুজিব’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে।
সেদিন সারা দেশ থেকে ছুটে আসা স্বাধীনতা-পাগল মানুষের ঢলে রেসকোর্স ময়দানের চতুর্দিকে জনবিস্ফোরণ ঘটে। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে নারী-পুরুষের স্রোতে তিলধারণের জায়গা ছিল না। বেলা ৩টায় রেসকোর্সে সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল থেকে মানুষের সমুদ্রে রূপ নেয়। রাজধানী ঢাকার চতুর্দিকে ছিলেন ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। আকাশে উড়তে থাকে হানাদারদের জঙ্গিবিমান।
বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি এখন বিশ্বের সম্পদ। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর জাতিসংঘের বিশ্বঐতিহ্য, সংস্কৃতি, শিক্ষাবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ বা বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এ স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য, বাঙালির জন্য অনন্য গৌরবের অর্জন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের সেই বিকেলে যারা সেই উত্তাল জনসমুদ্রে ছিলেন, সমকালকে তারা জানিয়েছেন- তাদের কাছে আজও সেই দিনটি জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন। সেদিনের রক্তের শিহরণ আজও তাদের দোলা দেয়।
বিশ্বনন্দিত ভাষণ: বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের কলজয়ী ভাষণকে বিশ্বনেতারা যুগে যুগে মূল্যায়ন করেছেন। বিভিন্ন সময়ে বিশ্বনেতাদের ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে মন্তব্য-বক্তব্য গণমাধ্যমে, নিবন্ধে প্রকাশিত হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে বলেছেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল দলিল।’
যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ৭ মার্চের ভাষণ মূল্যায়ন করে বলেছেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে সজীব থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারাবিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।’
কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো ৭ মার্চের ভাষণের উল্লেখ করে নিজের বক্তব্যে বলেছেন, ‘৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুধু একটি ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।’
যুগোস্লাভিয়ার কিংবদন্তি নেতা মার্শাল টিটো বলেছেন, ‘৭ মার্চের ভাষণের তাৎপর্য হচ্ছে, এই ভাষণের মাধ্যমে শেখ মুজিব প্রমাণ করেছেন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানিদের কোনোরকম বৈধতা নেই। পূর্ব পাকিস্তান আসলে বাংলাদেশ।’
১৯৭৪ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী শন ম্যাকব্রাইড বলেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতাই যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন মানুষের মুক্তি ও বেঁচে থাকার স্বাধীনতা। সাম্য ও সম্পদের বৈষম্য দূর করাই স্বাধীনতার সমার্থক ও সার্থকতা। আর এ সত্যের প্রকাশই ঘটেছে ৭ মার্চের ভাষণে।’
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মূল্যায়ন করে ১৯৭১ সালে ঢাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড তাৎক্ষণিক কূটনৈতিক বার্তায় লিখেছিলেন, ‘রোববার ৭ মার্চ প্রদত্ত মুজিবের ভাষণে তিনি যা বলেছিলেন, তার চেয়ে লক্ষণীয় হলো তিনি কী বলেননি। কেউ কেউ আশঙ্কা করছিলেন, আবার কেউ কেউ আশা করেছিলেন যে তিনি বাংলাদেশকে সরাসরি স্বাধীন ঘোষণা করবেন। এর বদলে বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।’
বিবিসির জরিপে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের সর্বকালের সেরা ভাষণগুলোর অন্যতম হিসেবে স্থান পেয়েছে। খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ড বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তব্য ও ভাষণের একটি সংকলন প্রকাশ করেছেন। সেখানে মাও সে তুং, উইনস্টন চার্চিল, আব্রাহাম লিঙ্কনের ভাষণের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
বিএনএনিউজ২৪/মনির/এমএইচ