।।আর করিম চৌধুরী।।
বিএনএ ডেস্ক: বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮০তম প্রয়াণ দিবস আজ।১৩৪৮ বঙ্গাব্দের বাইশে শ্রাবন তার জীবনাবসান ঘটে। বাঙালির সংস্কৃতি সত্তার বাতিঘর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ষা ঋতুকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। এই ঋতু নিয়ে তার অসংখ্য কবিতা, গান, ছোট গল্প, প্রবন্ধ রয়েছে। সেই বর্ষাতেই তিনি চির বিদায় নেন এই ধরাধাম থেকে।
রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জাতির দিকনির্দেশক এক আলোকবর্তিকা। বাঙালির প্রাত্যহিক জীবনের সবকিছুর সঙ্গেই একটু একটু করে মিশে আছে রবীন্দ্রনাথ! গত দেড় শতাব্দী ধরে বাঙালির মানসপটে তার দাপুটে অবস্থান। তাকে বাদ দিয়ে বাঙালির চিন্তার ভূগোল, ভাবের প্রকাশ, রস আস্বাদন— কিছুই সম্ভব না। বাঙালি সত্তায় রবীন্দ্রনাথ সদা জাগ্রত। বাঙালি জীবনে যত ভাব-বৈচিত্র্যের সমারোহ, তার পুরোটাই তিনি ধারণ করেছেন তার গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান, স্মৃতিকথা আর দর্শনে।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষাকে চিনিয়েছেন তিনি। ছিনিয়ে এনেছেন সাহিত্যের নোবেল।বাংলা ভাষার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত করা হয়।তার সাহিত্যকর্ম, সংগীত, জীবনদর্শন, মানবতা— সবকিছুই সত্যিকারের বাঙালি হতে অনুপ্রেরণা জোগায়।
১২৬৮ বঙ্গাব্দের পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম। মা সারদাসুন্দরী দেবী, বাবা কলকাতার বিখ্যাত জমিদার ও ব্রাহ্ম ধর্মগুরু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৭৫ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাতৃবিয়োগ ঘটে। পিতাকেও খুব একটা কাছে পাননি তিনি। কারণ, ১৫ সন্তানের জনক ব্রাহ্মগুরু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাৎসল্য প্রেম অতটা তীব্র ছিল না। অধিকাংশ সময় তিনি গৃহের বাইরে থাকতেন। ১৪তম সন্তান হিসেবে যখন রবীন্দ্রনাথের জন্ম, ততোদিনে গৃহের মায়া অনেকটা শিথিল হয়েছে দেবেন্দ্রনাথের। তাই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হয়েও ভৃত্যদের অনুশাসনে রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা কেটেছে।
শৈশবে কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নরম্যাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমি ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা করেন তিনি। ছেলেবেলায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অথবা বোলপুর ও পানিহাটির বাগানবাড়িতে প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই মুক্ত বিহঙ্গজীবনই একদিন তাকে ঘরে থেকে বের করে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিল।
৮ বছর বয়সে লিখতে শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আটপৌরে বাঙালির মতো কবিতা দিয়ে তার শুরুটা হয়েছিল এবং একদিন সেই কবিতাই তাকে তুলে ধরেছিল বিশ্ব দরবারে। হয়ে ওঠেন বিশ্বকবি।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৮৭৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশে ইংল্যান্ড যান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেখানে ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন তিনি। ১৮৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে আইনবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন।
কিন্তু গৃহের টান উপেক্ষা করতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। আজন্ম রোমান্টিক কবিকে যেন বাংলার নদী, বাংলার জল, বাংলার পাখি, বাংলার ফল হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। তাই মাত্র দেড় বছর ইংল্যান্ডে কাটিয়ে ১৮৮০ সালে কোনো ডিগ্রি না নিয়েই দেশে ফিরে আসেন। এর তিন বছরের মাথায় পারিবারিক রেওয়াজ মেনে ১৮৮৩ সালের ভবতারিণীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সদ্য কৌশোর পেরেনো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিবাহিত জীবনে ভবতারিণীর নামকরণ হয়েছিল মৃণালিনী দেবী। আর সংসার সাধনার মধ্যেই চলতে থাকে তার সাহিত্যচর্চা। ১৮৯১ সাল থেকে পিতার আদেশে নদিয়া, পাবনা, রাজশাহী ও উড়িষ্যার জমিদারি তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন তিনি। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে শিলাইদহ ছেড়ে বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের উপকণ্ঠে শান্তিনিকেতনে চলে যান। মৃত্যুর এক মাস আগে ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসের শেষের দিকে শান্তিনিকেতন ছেড়ে কোলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে ফিরে যান তিনি। সেখানেই ২২ শ্রাবণ তার মহাপ্রয়াণ ঘটে।
রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস,৩৬টি প্রবন্ধ, ৩৮টি নাটক ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তার জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছে।তার ভ্রমণ কাহিনী, চিঠিপত্রের সংকলনও বাংলা সাহিত্যের আকর গ্রন্থ হিসেবে সমাদৃত। ব্যকরণবিদ,সুর স্রষ্টা, শিল্প সমালোচক, সমাজ সংস্কারক,দার্শনিক,শিক্ষাবিদ হিসেবেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমানভাবে পরিচিত।
বিএনএনিউজ