বিএনএ, কক্সবাজার: নাগরিকত্ব দেয়া না হলে মিয়ানমারে ফিরে যাবে না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। শুক্রবার (৫ মে) সন্ধ্যা ৬টার দিকে মিয়ানমারের পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখে ফিরে এসে এ কথা জানান তারা।
এছাড়া, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু থেকে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে পালিয়ে আসার সময় যে গ্রাম রেখে এসেছিলেন তার কোনো অস্তিত্ব দেখেননি বলে দাবি করেছেন রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা। সেখানে তারা দেখেছেন সারিবদ্ধ ক্যাম্প।
প্রত্যাবাসনের পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখতে যাওয়া বাংলাদেশে বসবাসরত ২০ রোহিঙ্গাসহ ২৭ প্রতিনিধিদল শুক্রবার (৫ মে) বিকালে মিয়ানমার থেকে আসার পর এমন তথ্য জানিয়েছেন সফরে থাকা রোহিঙ্গা আবু সুফিয়ান।
তিনি জানান, মংডু শহরের আশপাশে কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখেছেন তারা। সেখানে গ্রামের কোনো অস্তিত্ব নেই। সবকিছু পাল্টে গেছে। তবে (মিয়ানমার সেনাবাহিনী) সারি সারি ক্যাম্প তৈরি করেছে। এসব ক্যাম্পেই রোহিঙ্গাদের নিয়ে রাখার পরিকল্পনা করছে মিয়ানমার।
রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের কয়েকজন সেখানকার পরিস্থিতি অসন্তোষজনক জানিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, রাখাইনে প্রত্যাবাসন উপযোগী পরিবেশ এবং পরিস্থিতি কোনোটাই নেই। ছয় বছর আগে ফেলে আসা তাদের জন্মভূমিতে গড়ে তোলা হয়েছে সেনা ব্যারাক, পুলিশ ফাঁড়ি, সীমান্তচৌকিসহ নানা অবকাঠামো। মংডুতে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য যে ভিলেজ নির্মাণ করা হচ্ছে, তাতে থাকতে রাজি হবে না রোহিঙ্গারা। জন্মভূমিতে নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা না পেলে কোনো রোহিঙ্গাই রাখাইনে ফিরতে রাজি হবে না।
সফরে থাকা মোহাম্মদ সেলিম নামে এক রোহিঙ্গা জানান, মিয়ানমারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তিনি নিজেই কথা বলেছেন। প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার দাবি জানালেও তাকে জানানো হয়েছে আপাতত নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না। এনভিসি কার্ডে তাদের ক্যাম্পে থাকতে হবে। মিয়ানমারের এমন শর্তে রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনে আগ্রহী হবে বলে মনে হয় না।
গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে প্রতিনিধিদলটি কক্সবাজারের টেকনাফের জালিয়াপাড়া ঘাট থেকে মিয়ানমারের উদ্দেশে যাত্রা করে। বেলা ১১টার দিকে তারা মংডু শহরে পৌঁছে। উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পের ২০ রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতাদের সঙ্গে নিয়ে যারা রোহিঙ্গা সংশ্লিষ্ট কাজে নিয়োজিত তাদের মধ্যে ৭ কর্মকর্তা এই সফরে যান। রোহিঙ্গাদের মধ্যে ১৭ পুরুষ ও তিন নারী ছিলেন। প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। প্রতিনিধিদলের সহযোগিতার জন্য ছিলেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সরকারি একাধিক সংস্থার আরও সাতজন সদস্য।
আরআরআরসি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান দাবি করেছেন, মিয়ানমারের মংডু শহরের আশপাশ পরিদর্শনকালে পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি দেখা গেছে। সেখানে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা, ব্যবসা করা মানুষের ৮০ শতাংশই দেখা গেছে রোহিঙ্গারা।সেখানে প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিস্থিতি রয়েছে।
তিনি বলেন, মিয়ানমারের একটি দল দ্রুত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ সফরে আসবে। ওই সফরে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হবে।
জন্মভূমিতে পুনর্বাসন করা না হলে রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরবেন না, রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের কয়েকজন সদস্যদের এমন মন্তব্য প্রসঙ্গে মিজানুর রহমান বলেন, এ রকম কথা বললে সমস্যার সমাধান হবে না। দুই পক্ষকে ছাড় দিতে হবে। সন্তুষ্টির বিষয়টা আপেক্ষিক। যে সমস্যা ৬০-৭০ বছর ধরে সমাধান হচ্ছে না, তা এক-দুই দিনে কীভাবে সম্ভব। আমরা প্রত্যাবাসন শুরু করতে চাই। প্রত্যাবাসন যেন টেকসই হয়, সে নিরিখে কাজ হচ্ছে।
আরআরআরসি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢল শুরু হওয়ার পর ২০১৮ সালে মিয়ানমারের কাছে প্রত্যাবাসনের জন্য ৮ লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা দিয়েছিল বাংলাদেশ। সে তালিকা যাচাই-বাছাই করে মাত্র ৬৮ হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা চূড়ান্ত করে তা বাংলাদেশের কাছে ফেরত পাঠিয়েছিল মিয়ানমার।
এর আগে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটিকে মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সেটি আর বাস্তবে আলোর মুখ দেখেনি। এরপর ২০১৯ সালের আগস্টে চীনের তরফ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর আরেকটি উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু নাগরিকত্বের বিষয়টি সুরাহা না হওয়ায় রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় যেতে চায়নি। এখন আবার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে চীনের তরফ থেকে এই তৃতীয় দফা উদ্যোগ নেওয়া হলো।
বিএনএ/ শাহীন, ওজি