নিজস্ব প্রতিবেদক:বিচার বিভাগ ডিজিটালাইজেশনের জন্য মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। ই-জুডিশিয়ারি শীর্ষক এ প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে প্রায় দেড় হাজারের বেশি এজলাসকে ডিজিটাল এজলাসে রূপান্তরিত করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে মামলা দায়ের থেকে শুরু করে আদেশ বা রায়ের অনুলিপি সবই মিলবে অনলাইনে। এতে মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়বে এবং জনগণ দ্রুত বিচার পাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০২০ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের জুন মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। খরচ ধরা হয়েছে দুই হাজার ৮৭৮ কোটি টাকারও বেশি। যার সম্পূর্ণ অর্থায়ন করবে সরকার। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের এ প্রকল্প বাস্তবায়নে কারিগরি সহায়তা দেবে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি (বিসিএস)।
সূত্র জানিয়েছে, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। সেটি এখন প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) দফতরে। পিইসি সভার জন্য এতে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্যামস্টেক উইংয়ের যুগ্ম প্রধান মো. আব্দুর রউফ স্বাক্ষর করেন।
পিইসি থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পর প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপন করা হবে।
ই-জুডিশিয়ারি ব্যবস্থা পুরোপুরি চালু হলে দেশের আদালতগুলোতে অনেক দ্রুত বিচার নিশ্চিত হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে নাগরিকদের ভোগান্তি কমবে
প্রকল্পের আওতায় যা করা হবে: প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এ প্রকল্পের আওতায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট থেকে শুরু করে নিম্ন (বিচারিক) আদালত এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ভার্চুয়াল পদ্ধতির আওতায় আনা হবে। আদালত এবং কারাগারে আটক ও অভিযুক্তদের মধ্যে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়া পরিচালনা, একটি স্বয়ংক্রিয় বিচারিক ব্যবস্থা এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম চালুর জন্য সারা দেশে ই-কোর্ট রুম স্থাপন এবং বিচারক, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের তথ্য প্রযুক্তিগত জ্ঞান বাড়ানো হবে। এজন্য সুপ্রিম কোর্টে সেন্ট্রাল ডাটা সেন্টার স্থাপনের পাশাপাশি ৬৪ জেলায় মাইক্রো ডাটা সেন্টার স্থাপন করা হবে।
এছাড়া প্রকল্পের কার্যক্রমে যেসব বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে আইন ও বিচার বিভাগের ডাটা সেন্টার আপগ্রেডেশন ও নেটওয়ার্ক অপারেটর সেন্টার স্থাপন, বিচার ব্যবস্থার সব অফিসের জন্য ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) স্থাপন, বিচার ব্যবস্থার জন্য এন্টারপ্রাইজ আর্কিটেকচার উন্নয়ন এবং এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্লানিং (ইআরপি) সফটওয়্যার উন্নয়ন।
এই প্রকল্পের আওতায় বিচারকদের জন্য দুই হাজারের বেশি উন্নত মানের ল্যাপটপ বা ট্যাব ক্রয় করা হবে। একইসঙ্গে রেকর্ডরুম স্বয়ংক্রিয়করণ এবং পুরনো রেকর্ডরুম ডিজিটালাইজেশন, বায়োমেট্রিক অ্যাটেনডেন্স সিস্টেম স্থাপন, ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেমের মাধ্যমে সাক্ষ্যগ্রহণ এবং ডিজিটাল এভিডেন্স রেকর্ডিং ও সেন্ট্রাল জেল টার্মিনাল স্থাপন করা হবে।
ই-কোর্ট রুম তৈরির জন্য নতুন আইন প্রণয়ন ও প্রচলিত আইনগুলোর প্রয়োজনীয় সংশোধন, বিচার ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ডেস্কটপ কম্পিউটার সরবরাহ এবং বিচার ব্যবস্থা ও মামলা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আইনজীবীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে।
এই মেগা প্রকল্প নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘সম্পূর্ণ বিচার বিভাগ ডিজিটালাইজড হয়ে যাবে। এর ফলে দ্রুত বিচার শেষ করতে পারব। ই-জুডিশিয়ারি যখন হয়ে যাবে তখন শুধু ভার্চুয়াল কোর্টই নয়, সব কিছুই পেপারলেস হয়ে যেতে পারে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের যে আজকাল মামলা জট হয়, এটির সমাধান হবে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘অনেক মামলা হয় ভয় দেখানোর জন্য। যেমন ধরুন, কাউকে হেনস্তা করার জন্য মামলা করা হলো। বাদীর উদ্দেশ্য হলো মামলায় কয়দিন তাকে জেল খাটানো যায় সেটা দেখা, ওই আসামিকে ভয় দেখানো। এক্ষেত্রে বিচারের শেষ দেখা আসল উদ্দেশ্য নয়। দেশে এ রকম মামলা এখন অনেক আছে, যেটা জট বৃদ্ধি করছে। ডিজিটালাইজড হলে সেটি শেষ করতে পারব। আর শুধু মামলাই শেষ করতে পারব না, জটবৃদ্ধির কারণগুলোও বুঝতে পারব।’
তিনি আরো বলেন, ‘মোবাইল ফোন হওয়ায় আমাদের যে উপকার হয়েছে, তেমনি এসব উপকারের জন্যই বিচার বিভাগ ডিজিটালাইজেশনের প্রয়োজন। বিচার বিভাগের অনেকগুলো বিষয় জড়িয়ে আছে, তাই ই-জুডিশিয়ারি করা হচ্ছে। এর মধ্যে কোর্ট ম্যানেজমেন্টসহ অন্যান্য সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকবে।’
এ বিষয়ে মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘প্রকল্প নিয়ে পুরোপুরি কোনো তথ্য এখনো পাইনি। তবে যেটা বলতে পারি সেটা হলো, বড় বড় দালান-কোঠা ও কম্পিউটারাইজড করতে পারেন, কিন্তু আইনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ যদি গণদরদী, গণমুখী না হয় এবং বিচারক যদি নিজের স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখতে না পারেন, তাহলে মেগা প্রজেক্ট দেখার জন্য ভালো হবে, কিন্তু জনগণের কোনো কল্যাণ আসবে না।