সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর বেরিয়ে আসছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)র সাবেক মেয়র মো. আতিকুল ইসলামের নানা অপকর্ম-দুর্নীতির তথ্য। ভাতিজা-ভাগিনাসহ আত্মীয়-স্বজনকে নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)কে পরিবারিক একটি সিন্ডিকেটে পরিণত করেছিলেন সদ্য সাবেক মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।
ঠিকাদারদের কাছ থেকে কমিশন, নিয়োগ, বদলি ও ময়লা বাণিজ্যসহ ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছেন রাজধানীর সেবাদানকারী এ প্রতিষ্ঠানটিকে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে খরচ করেছেন জনগণের করের টাকা। বাড়তি বিল ভাউচারে আপত্তি তোলায় কর্মকর্তাকে বদলি করার মতো নজিরও স্থাপন করেছেন সাবেক মেয়র আতিকুল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের প্রভাবশালীদের সঙ্গে সখ্য থাকার কারণে শত দুর্নীতি করেও ধরাছোঁয়ার বাহিরে ছিলেন দূর্নীতির এই বরপুত্র!
সরকারের ক্ষমতাবলে নিয়ম-কানুনের কোনো তোয়াক্কা না করে ইচ্ছামতো সিটি করপোরেশন পরিচালনা করেছেন ঢাকা উত্তরের সাবেক মেয়র আতিক। কাজের আগেই বিল দেওয়া, আগে কাজ করে পরে দরপত্র আহ্বান করে সাজানো বিল-ভাউচার তৈরি, পদ্মা সেতুর কর্মসূচিতে ডিএনসিসির টাকা খরচ, পানি ছিটানো, গাছ লাগানো, খাল পরিষ্কার, মশার নকল ওষুধ আমদানিসহ নানা খাতে লুটপাট চালিয়েছে আতিক প্রশাসন। শেষে ময়লা বাণিজ্যেও ভাগ বসান সাবেক এ মেয়র।
জানা গেছে, ২০২২ সালে পাঁচজন উপদেষ্টা নিয়োগ দেন আতিকুল ইসলাম। তাদের মধ্যে চারজন বিশেষজ্ঞ থাকলেও একমাত্র নিজের বড় ভাইয়ের ছেলে ইমরান আহমেদই ছিলেন ব্যতিক্রম। অন্যদের মতো বিশেষজ্ঞ না হয়েও তিনি নিয়োগ পান। নিজের মেয়ে বুশরা আফরিনকে চিফ হিট অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন সাবেক মেয়র। রাজধানীর কয়েকটি সড়কে গাড়ি থেকে ওপরের দিকে পানি ছিটিয়ে কৃত্রিম বৃষ্টি বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। এই কৃত্রিম বৃষ্টির নামে অন্তত ২ কোটি টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।
২০২৩ সালের শুরুতে ডিএনসিসির ১৯তম বোর্ড সভায়, বৃক্ষরোপণের জন্য শক্তি ফাউন্ডেশনের সঙ্গে একটি চুক্তি অনুমোদন করেন। ওই চুক্তির অধীনে সবুজায়ন এবং পরিবেশ উন্নয়নে নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। পরে সবুজায়ন সংক্রান্ত আরও একটি প্রকল্প দেওয়া হয় শক্তি ফাউন্ডেশনকে। এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা এবং নির্বাহী পরিচালক হুমায়রা ইসলাম সাবেক মেয়র আতিকুলের শ্যালিকা। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত আছেন আতিকুলের ভাই সাবেক প্রধান বিচারপতি তোফাজ্জল হোসেন, ভাগ্নে ইমরান এবং মেয়ে বুশরা আফরিন।
ভাগিনা তৌফিকের মাধ্যমে ঠিকাদার ম্যানেজসহ সিটি করপোরেশনের প্রায় সব ধরনের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন আতিক। ঠিকাদার ও কর্মচারী-কর্মকর্তারা তাকে দ্বিতীয় মেয়র হিসেবেই চিনতেন। তার কথায় কর্মকর্তারা ‘উঠতেন-বসতেন’। দেশ-বিদেশে সিটি করপোরেশনের যত বড় কর্মসূচি হয়েছে তার প্রায় সবগুলোতেই ভাগিনাকে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। সিটি করপোরেশনের কোনো পদে না থেকেও সব কর্মকান্ডে ছিল তৌফিকের নিয়ন্ত্রণ। এমনকি কর্মকর্তাদের নিজস্ব সভায়ও উপস্থিত থাকতেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঠিকাদারের সঙ্গে দেনদরবার করার কাজ করতেন তৌফিক এবং মেয়রের সহকারী একান্ত সচিব ফরিদ উদ্দিন। সাবেক মেয়রের সহকারী একান্ত সচিব ফরিদ উদ্দিনের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিডি ক্লিন। এই সংগঠনের ব্যানারে বেশ কয়েকটি প্রোগ্রাম করেন মেয়র। ২০২১ থেকে ২২ সালের মধ্যে বিশেষ অনুদান হিসেবে এই সংগঠনকে অন্তত ২২ লাখ টাকা দেয় ডিএনসিসি। এরপর আরও বেশ কয়েকবার অনুদান দেওয়া হলেও সেই কাগজপত্র খুঁজে পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা ধারণা করছেন, করপোরেশন থেকে চলে যাওয়ার আগে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি গায়েব করেন মেয়রের লোকজন।
মেয়র থাকাকালেই আতিকের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নের নামে বস্তি উন্নয়নের টাকা লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে খরচ হিসাব করে দেখা গেছে, বস্তি উন্নয়ন বিভাগের আড়াই কোটির বেশি টাকা লুটপাট হয়েছে কয়েকটি রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বনানী কবরস্থানে আগমন উপলক্ষে প্যান্ডেল, গেট ও লাইটিং করে ডিএনসিসি। এ বাবদ খরচ দেখানো হয় প্রায় ৫০ লাখ টাকা। একই বছর ৯ সেপ্টেম্বর শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে একই স্থানে একই খাতে প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়। ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবসেও প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে সেখানে ১০ লাখ টাকা খরচ দেখায় ডিএনসিসি। তাছাড়া মেট্রোরেলের উদ্বোধন উপলক্ষে ৪১ লাখ টাকা খরচ করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে খরচ করা হয় ৪০ লাখ ৩০ হাজার টাকা। ওই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর ডিএনসিসির উন্নয়ন কর্মকান্ড বিদেশিদের জানাতে একটি পাঁচ তারকা হোটেলে প্রায় ৫০ লাখ টাকা খরচ করে সংস্থাটি। বার্ষিক বনভোজন ও করপোরেশন সভার জন্য ৬৫ লাখ টাকা খরচ করা হয়।
জনপ্রতি ৭/৮ লাখ টাকা নিয়ে ২০২৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর সাতজন ঝাড়ুদারকে বিদ্যুৎ বিভাগের ইন্সপেক্টর বানিয়েছেন সাবেক মেয়র আতিক। একই বছরের মে মাসে আরও ২৫ জন কর্মচারীকে গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়।যতই দিন যাচ্ছে, ততই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের নানা অপকর্ম-দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসছে।
বিএনএনিউজ শামীমা চৌধুরী শাম্মী/এইচমুন্নী