বিএনএ, ঢাকা: সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের বিরুদ্ধে পুকুরচুরির অভিযোগ করেছেন ব্যাংকের ৫ পরিচালক।বাংলাদেশ ব্যাংক(বিবি) গভর্ণর ফজলে কবিরের বরাবরে গত ২৬ জুলাই প্রেরিত লিখিত পত্রে লাখো গ্রাহকের আমানত, ব্যাংকের দীর্ঘদিনের সুনাম রক্ষা ও যাবতীয় অভিযোগের দ্রুত নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছেন পরিচালকবৃন্দ।
পরিচালকগণ হলেন, ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও বর্তমান পরিচালক এম এ কাশেম, প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আজিম উদ্দীন আহমেদ, দুলুমা আহমেদ, রেহানা রহমান এবং জ্যোৎস্না আরা কাশেম।
পত্রে উল্লেখ করা হয়, ‘জালিয়াতি ও কারসাজির মাধ্যমে সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান বিপুল অংকের অর্থ আয় করেছেন। তিনি কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং দুবাইতে অর্থপাচার করেছেন। পাচার করা অর্থে এসব দেশের অভিজাত এলাকায় গড়ে তুলেছেন বাড়ি। দুবাইতে রয়েছে বিলাসবহুল হোটেল ও বার। ঢাকার গুলশানে রয়েছে তিনটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। গাজীপুরে বাড়ি ছাড়াও শ্ৰীপুর, ভাওয়াল এবং কাঁচপুরে অন্তত ১৫০ বিঘা জমির মালিক তিনি।
মামা-ভাগনা ব্যবসা
ব্যাংকের শাখাগুলোতে ফার্নিচার কিনতে পছন্দের কোম্পানি (জার্নিম্যান) নিয়োগ দেন। যেখানে প্রতিটি চেয়ারের দাম রাখা হয়েছে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা, কম্পিউটার টেবিলের দাম ধরা হয়েছে ৬২ হাজার টাকা। এভাবেই নিজের ভাগনের কোম্পানির মাধ্যমে ফার্নিচার কেনার নামে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।জার্নিম্যান এর এক কোটি টাকা সুদও মওকুফ করেছেন তিনি।’ অভিযোগ রয়েছে, নামে-বেনামে তার রয়েছে আরও একাধিক বাড়ি-ফ্ল্যাট ও প্লট।
পত্রে বলা হয়,, ‘ব্যাংকটিতে এখন নিয়ম বলতে কিছু নেই। নিজস্ব লোকদের ঋণ দেয়া, চলতি ঋণের সুদ মওকুফ করে দেয়া, যাকে-তাকে ঋণ দেয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান অন্য সব পরিচালককে পাশ কাটিয়ে বিভিন্ন অযোগ্য প্রতিষ্ঠানের ঋণ অনুমোদন করেন।
‘সাউথইস্ট ব্যাংকে বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ক্যাপিটাল লিমিটেডের ২১০ কোটি টাকা ঋণ থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকটির পরিচালক হন আলমগীর কবির নিয়ন্ত্রিত বে-লিজিংয়ের মনিরুজ্জামান। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এ তথ্য গোপন রাখা হয়। ফলে ২০২০ সালে এনওসি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এখানেই দুর্নীতির শেষ নয়। পরিচালক হিসেবে ব্যাংকের দুই দশমিক ৩৫ শতাংশ শেয়ার অর্থাৎ প্রায় ২৭ কোটি টাকার মালিকানা বুঝে পায় বে- লিজিং। আইন অনুযায়ী এ মালিকানার বিপরীতে সাড়ে ১৩ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার অনুমতি রয়েছে। অথচ বে-লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট বর্তমানে সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে ৪০০ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা ভোগ করছে। সাউথইস্ট ব্যাংকের কলমানি থেকে ঋণ পাওয়া একমাত্র প্রতিষ্ঠানের নামও বে-লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট।’
পত্রে আরও বলা হয়, ‘আলমগীর কবিরের নিকটাত্মীয়ের (বেয়াই) মালিকানাধীন লুব-রেফ বাংলাদেশ লিমিটেডকে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে ৫৪ কোটি টাকার অধিক সুদসহ ঋণ মওকুফ করা হয়েছে। কমিশন সুবিধা নিয়ে এক হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের অভিযোগও রয়েছে আলমগীর কবিরের বিরুদ্ধে। যেসব ঋণের বিপরীতে পাঁচ বছর কোনো সুদ দিতে হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে জাজ ভূঁইয়া গ্রুপ (৩০০ কোটি), সুয়াদ গার্মেন্টসের ১৫ কোটি, ফাহমি নিটের ৩০০ কোটি, সিঙ্গেল বরোয়ার এক্সপোজার লিমিট অতিক্রম করে কেয়া গ্রুপের ৯০০ কোটি এবং মাহাবুব স্পিনিংয়ের ১৫০ কোটি টাকা উল্লেখযোগ্য।’
পত্রে উল্লেখ করা হয়, ‘সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলমগীর কবির গ্রাহকদের মধ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেন; যেগুলোর বিপরীতে পাঁচ বছরে কোনো প্রকার সুদ না দেয়ার সুবিধা দিয়েছেন তিনি। তারপরও ক্লায়েন্টের ঋণের টাকা তাদের ‘সুদমুক্ত ব্লকড অ্যাকাউন্ট’-এ দিয়ে দেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে- জাজ ভূঁইয়ার ৩০০ কোটি টাকা, সুয়াদ গার্মেন্টসের ১৫ কোটি, ফাহমি নিটের ৩০০ কোটি, কেয়া গ্রুপের ৯০০ কোটি, মাহাবুব স্পিনিংয়ের ১৫০ কোটি টাকার ঋণ।’
পত্রে ৫ পরিচালক আরও অভিযোগ করেন, নিয়মনীতির অমান্য করে যাকে তাকে ঋণ দেয়ার জন্য আগেও সমালোচনায় এসেছেন আলমগীর কবির। ব্যক্তিস্বার্থে অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেন তিনি। যার কারণে অযোগ্য হয়েও ব্যাংকটি থেকে গোপাল আগরওয়ালা ও তার স্ত্রী দীপা আগরওয়ালা ১১৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ভারতে পালিয়েছেন। উভয়ই সাউথইস্ট ব্যাংকের নওগাঁ শাখার গ্রাহক ছিলেন। এই জালিয়াতিতে আলমগীর কবিরের হাত রয়েছে। তিনি মূলত আগারওয়ালা দম্পতিকে কাজে লাগিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভারতে পাচার করেছেন। কলকাতা এবং চেন্নাইতে তার একাধিক বাড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় জমিজমাও রয়েছে। গোপাল আগারওয়ালা বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার জগন্নাথ নগরে জেএন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে অটোরাইস মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। দীপা আগারওয়ালা একই স্থানে ‘মেসার্স শুভ ফিড প্রসেসিং’ নামের একটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের মালিক।
১৯৯৫ সালে বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে সাউথইস্ট ব্যাংকের যাত্রা শুরু করে। ২০০৪ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে অন্য উদ্যোক্তা-পরিচালকরা নিয়মিতভাবে নির্বাচিত হয়েছেন এবং দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ সালে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে যুক্ত হন আলমগীর কবির। তিনি সাউথইস্ট ব্যাংকের উদ্যোক্তাও ছিলেন না। ২০০৪ সালে তিনি চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব নেন এবং টানা ১৭ বছর এ পদে আসীন।সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলমগীর কবির মূলত সৌদিপ্রবাসী ছিলেন। জালালুর রহমান নামে এক পরিচালকের কাছ থেকে স্পন্সর শেয়ার কেনেন তিনি। এরপর শুরু হয় আলমগীর কবিরের জালিয়াতি। তার ছেলে রাইয়ান কবির ২০০৩ সালে সাউথইস্ট ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগে চাকরি নেন।পরে নানা অনিয়মের মাধ্যমে ছেলেকেও ব্যাংকের পরিচালক বানান আলমগীর কবির।
বিএনএনিউজ,জিএন