বিএনএ, ঢাকা: চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় ২৪ বছর বয়সী মিলন হোসেন নামে এক যুবককে ৯ টুকরা করে কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় পদ্মা নদীর চরে বালি চাপা দেওয়া হয়েছে। এক সপ্তাহ পর পুলিশ মিলনের ৯ টুকরা মরদেহ উদ্ধার করেছে। মরদেহ টুকরাগুলো সাতটি ব্যাগে রাখা ছিল।
শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে গতকাল শনিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত পদ্মার চরে অভিযান চালিয়ে এগুলো উদ্ধার করে পুলিশ। এছাড়া হত্যাকাণ্ডে ও মরদেহ খণ্ড-বিখণ্ড করার কাজে ব্যবহৃত বড় যাঁতি, লোহাকাটা ব্লেডসহ বিভিন্ন সামগ্রী উদ্ধার করেছে। কিশোর গ্যাং লিডার এস কে সজীবসহ ৫জনকে আটক করেছে পুলিশ।
নিহত মিলন হোসেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার বাহিরমাদি গ্রামের মাওলা বক্স সরদারের ছেলে। তিনি স্ত্রী মিমি খাতুনকে নিয়ে কুষ্টিয়া শহরের হাউজিং এস্টেটের ‘ই’ ব্লকে ভাড়া বাসায় থাকতেন। টেক্সটাইল প্রকৌশলে লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি অনলাইনে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করতেন। এ কাজের মাধ্যমে প্রচুর টাকা আয় করতেন মিলন।
পুলিশ জানিয়েছে, চাঁদার দাবিতে কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সাবেক সহসভাপতি এস কে সজীবের নেতৃত্বে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ সজীবসহ পাঁচ জনকে আটক করেছে। তাদের জেলা গোয়েন্দা কার্যালয়ে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
পুলিশ জানায়, খুনিরা মিলনকে কৌশলে ডেকে এনে একটি বাড়িতে আটকে রেখে তার ওপর চালায় বর্বর নির্যাতন। পরবর্তী সময়ে তারা মিলনকে হত্যার পর লাশ ৯ টুকরা করে বিভিন্ন অঙ্গ চটের ব্যাগে ভরে পদ্মা নদীর দুর্গম চরের একাধিক স্থানে পুঁতে রাখে। আটক অন্যরা হলেন—সদর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের কান্তিনগর গ্রামের জহির রায়হান ওরফে বাবু, সদরের কুমারগাড়া এলাকার ফয়সাল আহমেদ, হাউজিং এষ্টেট এলাকার বাসিন্দা ইফতি খান ও সজল।
পুলিশ জানায়, গত ৩১ জানুয়ারি শহরের হাউজিং এস্টেট এলাকার বাড়ি থেকে মিলনকে তার এক বন্ধু ডেকে নেওয়ার পর থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন। মিলন বাড়ি ফিরে না আসায় তার স্ত্রী মিমি খাতুন কুষ্টিয়া মডেল থানায় জিডি করেন। ঐ জিডির সূত্র ধরে পুলিশ মিলনকে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে। তদন্তের এক পর্যায়ে পুলিশ সন্দেহভাজন এক যুবককে আটক করে। পরে ঐ যুবকের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আরো চার জনকে পুলিশ আটক করেছে।
আটককৃতদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ও তাদের দেখিয়ে দেওয়া স্থানে শুক্রবার রাত থেকে প্রায় ১৫ ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে পুলিশ পদ্মা নদীর বালু চরে পৃথক স্থানে চারটি চটের ব্যাগে পুঁতে রাখা মিলনের খণ্ডিত ৯ টুকরা লাশ উদ্ধার করে। পৈশাচিক এ হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে পদ্মার চর এলাকার শত শত মানুষ সেখানে ছুটে যায়।
নিহতের স্ত্রী মিমি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘নিখোঁজ হওয়ার পরদিন দুপুর দেড়টা পর্যন্ত আমার স্বামীর ফোন চালু ছিল। আগের দিন সন্ধ্যায় থানায় গেছি। থানায় মিলনের ফোনের লোকেশনও দেখাইছে। আমার স্বামী লাশ হওয়া পর্যন্ত এরা অপেক্ষা করছিল। গিয়ে যে একটু তদন্ত করবে, তাও করেনি পুলিশ।’
তিনি বলেন, ঐ দিন বেলা ১১টার দিকে সজল নামে একজন ফোনে মিলনকে ডেকে নিয়ে যান। ১৫-২০ মিনিট পর ফেরার কথা থাকলেও মিলন না ফেরায় তিনি দুপুরে ফোন করেন। তখন মিলন বলেন, দুই-তিন ঘণ্টা সময় লাগবে। সেটাই মিলনের সঙ্গে শেষ কথা তার।
কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পলাশ কান্তি নাথ জানান, ঘটনাটি পৈশাচিক ও খুবই দুঃখজনক। তবে দ্রুত পদক্ষেপের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আটক করা গেছে এবং ঘটনার প্রাথমিক ক্লু সম্পর্কেও জানা গেছে। তদন্তে হত্যায় আরো কেউ জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।
তিনি বলেন, আটককৃতদের দেখানো জায়গা থেকে লাশের ৯টি টুকরা উদ্ধার করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পর সজীব শহরেই স্বাভাবিকভাবে ঘোরাফেরা করছিলেন। পুলিশ তাকেসহ আরও চার জনকে শহর থেকে আটক করে হেফাজতে নেয়।
মিলন হোসেন হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা এস কে সজীব। তিনি জেলা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সাবেক সহ-সভাপতি । পাশাপাশি পুলিশের তালিকাভুক্ত কিশোর গ্যাং-প্রধান । তার নেতৃত্বে কুষ্টিয়া শহরে একটি গ্যাং চলে। সাত মামলার আসামি সজীবের একটি মামলায় দুই বছরের সাজাও হয়েছে। জানা গেছে, বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতি করছেন সজীব। তবে কোনো পদ-পদবি নেই।
পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, সজীবের বাবার নাম মিলন শেখ। শহরের আড়ুয়াপাড়ার হরিবাসর এলাকায় তাদের বাড়ি। সজীবের নামে কুষ্টিয়া মডেল থানায় মাদক, চাঁদাবাজি, হামলাসহ নানা অভিযোগে পুরোনো সাতটি মামলা আছে। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে এক নারী ইন্টার্ন চিকিৎসককে মারধরের মামলায় তার দুই বছরের সাজাও হয়েছিল। সর্বশেষ মিলন হোসেনকে অপহরণ ও হত্যার মিশনে নেতৃত্ব দেন সজীব।
পুলিশ সূত্র জানায়, হাউজিং এলাকায় তাদের একটি কার্যালয় আছে। সেখানে লোকজনকে ধরে এনে নির্যাতন করে চাঁদা আদায় করা হয়।
জানা গেছে, সজীব কলেজে পড়ালেখা না করেও হঠাৎ করে ছাত্রলীগের পদ পেয়ে যান। ইয়াসির আরাফাত ও সাদ আহাম্মেদের নেতৃত্বাধীন কমিটিতে ২০১৭-১৮ সালের দিকে প্রথম সহসম্পাদকের পদ পান। তখন থেকেই শহরের হাউজিং এলাকায় কিশোর গ্যাং তৈরি করে এলাকায় চাঁদাবাজি, মারধর, মাদকের কারবারসহ নানা অপকর্ম শুরু করেন। এরপরও নেতাদের সুপারিশে জেলা ছাত্রলীগের সর্বশেষ কমিটিতে সহসভাপতির পদ পেয়ে যান। শহরে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিতে দেখা যায় তাকে। জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ হাফিজ ওরফে চ্যালেঞ্জের ওপর হামলাসহ নানা অপকর্মের কারণে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
বিএনএ/ শামীমা চৌধুরী শাম্মী, ওজি/ হাসনা