বিএনএ, সাভার: ঢাকার ধামরাইয়ের বারবাড়িয়া এলাকায় গাজীখালী নদীর ওপর অবৈধ ট্রাক টার্মিনাল গড়ে তোলা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। টার্মিনালে প্রতিদিন ট্রাকপ্রতি ১০০ টাকা ও মাসিক ৩ হাজার টাকা করে নেওয়া হয় বলেও জানা যায়। সরকারি জমিতে অবৈধ এ টার্মিনাল থেকে প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র।
এ বছরের মার্চ মাসে উপজেলার গাঙ্গুটিয়া ইউনিয়নের বারবাড়িয়া গ্রামে এ টার্মিনাল গড়ে তোলা হয়।
তথ্য বলছে, গাঙ্গুটিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের মোল্লার পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক কমিটির ধামরাই শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান, চেয়ারম্যানের ভাতিজা আবু বক্কর সিদ্দিক, বিএনপি কর্মী মো. মোস্তফা এ টার্মিনাল গড়ে তোলেন। আদায় করা অর্থ তারা ভাগাভাগি করে নেন।
টার্গেট যেসব ট্রাক
উপজেলার বারবাড়িয়া গ্রামে আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, ইনসেপটা ফার্মাসহ কয়েকটি মিল-কারখানা রয়েছে। এসব কারখানার মালামাল বহন করে দূরপাল্লার ভারি ট্রাক। এসব ট্রাক আগে কারখানার আশেপাশে ও সড়কের পাশে ফাঁকা জায়গায় মালামাল নেওয়ার অপেক্ষা করতো। এই ট্রাকগুলোকে টার্গেট করেই টার্মিনাল গড়ে তোলা হয়। টার্মিনালে ট্রাক না রাখলে চালকদের ভয়ভীতি দেখানো ও সড়কের পাশে দাঁড়াতে দিত না ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক কমিটির স্থানীয় নেতারা। এমনকি তারা চালকদের মারধর, গাড়ির আয়না ভেঙে দেওয়ার ঘটনাও ঘটাতো। এভাবেই তারা চালকদের সেখানে ট্রাক রাখতে বাধ্য করে।
যশোরের বাসিন্দা ও দূরপাল্লার ভারি ট্রাকের এক চালক নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, তিনি নিয়মিত আকিজ ফুড থেকে মালামাল আনা নেওয়া করতেন। কয়েকমাস আগে তিনি কারখানার অপর পাশের ইসলামিয়া হোটেলের সামনে ট্রাক রেখেছিলেন। সেখানেই তার ট্রাকের লুকিং গ্লাস ভেঙে ফেলা হয়। এমনকি তাকে চড়থাপ্পড়ও মারা হয়। এরপর থেকে তিনি ওই টার্মিনালে ট্রাক রাখেন।
ওই চালক বলেন, এখন বাধ্য হয়ে ওখানে ট্রাক রাখতে হয়। দশ মিনিট রাখলেও তাদের ১০০ টাকা দিতে হয়।
দিনপ্রতি ও মাসিকভাবে দিতে হয় টার্মিনাল ফি
ট্রাক চালক ও টার্মিনালের সংশ্লিষ্ট একজন জানান, টার্মিনালে প্রতিদিন ট্রাক রাখতে ১০০ টাকা করে ফি দিতে হয়। গাড়ির আকার ভেদে টাকার পরিমাণ একই থাকে। দিনপ্রতি ছাড়াও মাসিক ভিত্তিতেও ট্রাক রাখা যায়। মাসিকভাবে ট্রাক রাখলে ট্রাক প্রতি ৩,০০০ টাকা করে দিতে হয়।
ট্রাক রাখার কথা বলে টার্মিনালের সংশ্লিষ্ট ওই ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘ট্রাক এই এলাকায় কোথাও রাখলে আমাদের এখানে রাখতে হবে। আর সব ট্রাক এক রেট ১০০ টাকা করে।’
সরকারি জমিতে টার্মিনাল, লাখ টাকা নিচ্ছে চেয়ারম্যান ও তার সহযোগীরা
টার্মিনালটি গড়ে উঠেছে ঢাকা-মানিকগঞ্জ জেলার মৈত্রী সেতুর ঠিক নিচে গাজীখালি নদীর ওপর। বর্ষাকালে যাতে টার্মিনালের আশপাশে পানি না আসে সেজন্য পাশেই বাঁধ দেওয়া হয়েছে। টার্মিনালের পাশেই ডাইভারশন সড়ক গড়ে তোলা হয়েছে। সড়কটি সোজা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে উঠে যায়। ওই সড়কটি করা হয়েছে সড়ক ও জনপথ বিভাগের জমিতে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টার্মিনালের এক কর্মী জানান, টার্মিনালে প্রতিদিন প্রায় ১০০টি করে গাড়ি থাকে। তবে রাতে গাড়ির সংখ্যা বাড়ে। তাতে প্রতি মাসে ৪-৫ লাখ করে টাকা আয় হয়। রাতে টার্মিনাল পাহারা দেওয়ার জন্য মাসিক ৯,৫০০ টাকা ভিত্তিতে একজন পাহারাদার নিয়োগ করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টার্মিনালের ওই কর্মী জানান, টার্মিনালের আয় করা টাকার একটি বড় ভাগ যায় গাঙ্গুটিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের মোল্লার কাছে। তিনি প্রায় ১ লাখ করে টাকা পান এই টার্মিনাল থেকে। এছাড়া আব্দুল মান্নান পান ১ লাখ, আবু বক্কর ৫০ হাজার, ধামরাই থানা, গোলড়া হাইওয়ে পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আলতাফ হোসেন, বজলুর রহমানসহ একটি প্রভাবশালী চক্র পায় কয়েক হাজার করে টাকা।
বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক কমিটির ধামরাই শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান বলেন, ‘টার্মিনালের কোনো ইজারা হয়নি। আগে রাস্তার ওপরে গাড়ি রাখতাম। ওই জায়গাটা ফাঁকা, তাই ওখানে আমাদের গাড়িগুলো রাখি। ওইখানে ইটের আঁধলা, লাইটিং সবকিছু মিলিয়ে অনেক খরচ করে ফেলেছি।’
টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমরা সবসময় ওখানে থাকি না। যদি ওরকম কাজ কেউ করে, ব্যবস্থা নিবো। আমার গাড়ি থাকলে টাকা দেই। আমরা কোনো টাকা নেই না। নাইটগার্ডের জন্য ১০-২০ টাকা করে দেয় অনেকেই। আর আমরা যে গাড়ি রাখি, সেটার জন্য টাকা দেই নিজেরাই।’
চেয়ারম্যান কাদের মোল্লাকে টাকা দেওয়া হয় কি না প্রশ্নে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কোনো টাকাই নেই না। ভাগের কিছু নাই।’
গাঙ্গুটিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের মোল্লা বলেন, ‘টার্মিনালের বিষয়টি জানি। আপনারা স্পটে এসে জিজ্ঞেস করেন ইজারা হয়েছে কি না। টাকা নেওয়ার বিষয়টা আমার জানা নাই। যারা পাহারা দেয়, গাড়ি রাখে তারা ৫০-১০০ টাকা করে দেয়।’
বিষয়টি অবৈধ কি না প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আপনি মামলা করেন। খালি রিপোর্ট কইরেন না।’
ধামরাই থানার পুলিশ পরিদর্শক (ওসি) হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আমি এরকম কিছু জানি না। আমি নতুন এসেছি। এরকম যদি কেউ করে তাকে আমার কাছে পাঠান। আমরা তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিবো।’
সড়ক ও জনপথ বিভাগের মানিকগঞ্জ জোনের প্রকৌশলী আরাফাত সাকলাইন বলেন, ‘বারবাড়িয়া টার্মিনাল করা হয়েছে, বিষয়টি জানা নেই। টাকা নেওয়ার বিষয়টিও জানা নেই। আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাবো বিষয়টি। তারা ব্যবস্থা নেবেন।’
ধামরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) হোসাইন মোহাম্মদ হাই জকী বলেন, ‘আমার ট্রাক টার্মিনালের বিষয়টি জানা নেই। আমরা কোনো ইজারা দেইনি।’
বিএনএ/ ইমরান, এমএফ/ এইচ এইচ