বিএনএ,কক্সবাজার: কক্সবাজারের ৩৩ টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দারা উদ্বেগ, উৎকন্ঠা ও অজানা আতংকে ভয়াবহ অস্থির সময় পার করছেন। গত সাড়ে পাঁচ বছরে খুন হয়েছে ১৩৮ জন। শুধুমাত্র গত পাঁচ মাসে খুন হয় ৩৯ জন। অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৪ জন। যাদেরকে মোটা অংকের মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে আনতে হয়েছে।
এ ভাবে ক্যাম্পে বাড়ছে খুন, ধর্ষণ,মাদক, মানবপাচার ও অপহরণের মতো ঘটনা। রোহিঙ্গাদের মধ্যে গোলাগুলি, আধিপত্য বিস্তার, মাদক, অস্ত্রসহ সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়ায় নানান শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্থিরতা বিরাজ করছে।
এছাড়া ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের যোগাযোগের তথ্য রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। আর বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের শূন্য রেখায় অর্ধশত সুড়ঙ্গের অস্তিত্বও মিলেছে সম্প্রতি। স্থানীয়রা শূন্য রেখায় বাংকার দেখেছেন। এসব নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। একই সঙ্গে বৃদ্ধি করা হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি।
অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশ শুধু নিরাপত্তা ঝুঁকিতেই পড়েনি, অর্থনৈতিক ঝুঁকিও বাড়ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে (মিয়ানমার) নিরাপদ প্রত্যাবাসনকে এর সমাধান বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত ১০ ডিসেম্বর কক্সবাজারের উখিয়া ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের দুই গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি হয়। ওই ঘটনায় দুই রোহিঙ্গা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
এর কিছুদিন পর ২৬ ডিসেম্বর উখিয়ায় সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাত ও গুলিতে ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা বা হেড মাঝি মোহাম্মদ হোসেন (৪০) নিহত হন। এরপর ৬ জানুয়ারি উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গোলাগুলিতে মোহাম্মদ নুরুন্নবী (৪০) নামে এক রোহিঙ্গা গুলিবিদ্ধ হন। পরে তার ঘরে তল্লাশি চালিয়ে গ্রেনেড উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এরপর গত ১৮ জানুয়ারি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিচ্ছিন্নতাবাদী দুটি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশনের (আরএসও) সদস্যদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয়। এ সময় গোলাগুলিতে হামিদুল্লাহ নামে এক রোহিঙ্গা নিহত হন। দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। এতে পুড়ে যায় প্রায় পাঁচশ ঘর। ফলে দেখা যাচ্ছে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সংঘর্ষ, খুন, অস্ত্র, মানবপাচার, মাদক চোরাচালানসহ নানা ধরনের অপরাধ হচ্ছে।
এ বিষয়ে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা সবকিছু ফেলে এখানে (বাংলাদেশে) চলে এসেছে। যেকোনো প্রলোভনে প্রলুব্ধ হয়ে তারা যে কোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারে। রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের ভেতরে থেকে ইয়াবা ব্যবসা, নিজেদের মধ্যে গোলাগুলি, মারামারি করছেন প্রতিনিয়তই। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ডিজিএফআইয়ের এক কর্মকর্তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলা, গোলাগুলি, কাঁটাতারের বেড়া কেটে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা নিয়ে আসছেন তারা। ফলে রোহিঙ্গা ক্যাম্প আমাদের জন্য একটা বিষফোঁড়া হবে কোনো এক সময়।
রোহিঙ্গা বিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের তথ্যমতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এছাড়া ক্যাম্পগুলোতে প্রতি বছর ৪০থেকে ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিচ্ছে। এ হিসাবে সাড়ে ৫ বছরে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হয়েছে। ফলে এখন রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাড়ে ১৪ লাখের বেশি। বিশাল এই জনগোষ্ঠীতে আরসা, আল ইয়াকিনসহ অন্তত ১৫টি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন সক্রিয়।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন অপরাধী চক্রের নেতৃত্বে চলে মাদক কারবার, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধ। এমনকি আধিপত্য বিস্তারে সশস্ত্র মহড়া, অপহরণ, মানবপাচার, সংঘর্ষেও জড়াচ্ছে তারা। পাশাপাশি আধিপত্য বিস্তারের জেরে চলছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষসহ একের পর এক হত্যাকাণ্ড।
আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের- এপিবিএন তথ্য বলছে, ২০২১ ও ২০২২ সালে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক হাজার ১৬৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হন এক হাজার ৬৮৫ রোহিঙ্গা। এগুলোর মধ্যে ৪১টি হত্যা মামলা, ৪০টি অপহরণ মামলা রয়েছে। এছাড়াও ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলায় ১১টি ও ৯৭টি অস্ত্র মামলা। তবে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে মাদক সংক্রান্ত ৯৭৮টি।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গারা ২০১৭ সালে আসার পর থেকে যেসব অপরাধে জড়িত ছিল এখনো সেই ধরনের অপরাধ করছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের গ্রুপ রয়েছে। তারা নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মারামারি, সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। এমনকি খুন, মাদক, চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে অনেক রোহিঙ্গা। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কারণে তারা নিজেদের জন্যই ঝুঁকি তৈরি করছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন এনজিওর তত্ত্বাবধানে ক্যাম্পে সাধারণ রোহিঙ্গারা নিরাপদে আছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এছাড়া ক্যাম্পগুলোতে প্রতি বছর ৪০ থেকে ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিচ্ছে। এ হিসাবে ৫ বছরে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হয়েছে। ফলে এখন রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাড়ে ১৪ লাখের বেশি।
২০২১ সালে জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের হিসাবে দেখা গেছে, শুধুমাত্র ১০ লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গার জন্য মোট সহায়তা প্রয়োজন ছিল ৯৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ২৬৯ মিলিয়ন ডলারের ঘাটতি ছিল। অর্থাৎ ২০২১ সালে রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণে যে পরিমাণ সহায়তার প্রয়োজন ছিল, দাতাদের (বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা) কাছ থেকে তার থেকে ২৬৯ মিলিয়ন ডলার কম সহায়তা মেলে। প্রতি বছরই ছিল এমন ঘাটতি, যার প্রায় পুরোটাই বহন করতে হয়েছে বাংলাদেশকে।
বিএনএ/ এইচ এম ফরিদুল আলম শাহীন, ওজি