বিএনএ ডেস্ক: রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একাধিক মামলা থাকায় ডিবি পুলিশের একটি দল রাজধানীর বংশাল থেকে রবিবার (১ সেপ্টেম্বর) রাতে তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
হাজী মোহাম্মদ সেলিম ৫ অক্টোবর ১৯৫৮ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা চান মিয়া সরদার ও মাতা সালেহা বেগম। তিনি নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। ১৯৯৬ সালে হাজী সেলিম ঢাকা-৮ আসন থেকে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সাধারণ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও বিএনপির নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর নিকট পরাজিত হন। ২০১৪ সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয় না পাওয়ায় তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং নিজ দলীয় প্রার্থী মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করায় অবিভক্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এর পদ হারান। ২০১৪ সালে, সেলিম সংসদের ১৬ জন স্বতন্ত্র সদস্যদের নিয়ে জোট গঠন করেন। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেলিম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে পুনরায় অংশগ্রহণ করেন এবং বিজয়ী হন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন হাজি সেলিম। পরে হাসপাতালে গিয়ে আশ্রয় নেন তিনি। এর আগে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় ২০০৮ সালে ১৩ বছরের সাজা হয় হাজি সেলিমের। পরবর্তীতে ২০২২ সালে এই সাজা কমিয়ে ১০ বছর করে হাইকোর্ট।
পান বিক্রেতা থেকে যেভাবে এমপি
বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়কে কাজে লাগিয়ে পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাটের পান ব্যবসায়ী থেকে হাজী মোহাম্মদ সেলিম হয়ে উঠেছেন বড় কনগ্লোমারেট মদিনা গ্রুপের মালিক। গত তিন দশকে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন তিনি। অভিযোগ আছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও পেশিশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ব্যবসায়িক উত্থান ও সমৃদ্ধি হয়েছে।
জানা গেছে, স্বাধীনতার আগে হাজী সেলিমের বাবা চান মিয়া ছিলেন সোয়ারীঘাটের পান বিক্রেতা। পিতার সঙ্গে পান বিক্রির মধ্য দিয়ে ব্যবসার জগতে পা রাখেন হাজী সেলিম। স্বাধীনতার পরও পান বিক্রি করেই সংসার চলত পরিবারটির। একপর্যায়ে কোমলপানীয় সেভেন আপের এজেন্সি খুলে বসেন তারা। ওই এজেন্সির আড়ালে নকল কোমলপানীয় বিক্রির অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে। সে সময় মোহাম্মদ সেলিম, তার বাবা চান মিয়া ও বড় ভাই কায়েস মিয়াকে পুলিশ আটকও করেছিল। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ১৯৭৮-৭৯ সালের দিকে মদিনা ট্রেডিং করপোরেশন নামে সিমেন্টের ব্যবসায় নামেন মোহাম্মদ সেলিম। শুরুর দিকে বাদামতলী থেকে জমাটবাঁধা সিমেন্ট এনে তা ক্র্যাশ করে বিক্রি করা হতো।
যেভাবে রাজনীতিতে উত্থান হয় হাজী সেলিমের
নব্বইয়ের দশকে বিএনপি নেতা মীর শওকতের হাত ধরে রাজনীতিতে উত্থান হয় হাজী সেলিমের। ১৯৯৪ সালে তিনি ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৬৫ ও ৬৬ নম্বর ওয়ার্ডে গরুর গাড়ি মার্কা নিয়ে কমিশনার নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলেন হাজী সেলিম। কিন্তু মনোনয়ন না দেয়ায় যোগ দেন আওয়ামী লীগে। আওয়ামী লীগ তাকে মনোনয়ন দেয়। লালবাগ, হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর থানা নিয়ে গঠিত নির্বাচনী এলাকায় বিপুল ভোটে জয়লাভ করে এমপি হন হাজী সেলিম। এরপর ক্ষমতার ছত্রছায়ায় ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকে তার ব্যবসা ও সম্পত্তির পরিমাণ। তার প্রতিষ্ঠিত মদিনা গ্রুপের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৯ সালের মধ্যেই গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত বার্ষিক টার্নওভার ৬০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। পরের বছরগুলোয় এ সংখ্যা ক্রমেই বেড়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, যেখানেই চোখ পড়েছে হাজী সেলিমের, সেটাই দখল করে নিয়েছেন তিনি। তার হাত থেকে রেহাই পায়নি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও। হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে গত বছরও ঢাকার প্রথম বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে পরিচিত চকবাজারের শতবর্ষেরও বেশি পুরনো জাহাজবাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছেন হাজী সেলিম। ক্ষমতাধর হওয়ার কারণেই হাজী সেলিম ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে কেউ থানায় অভিযোগ করতে চায়নি। এভাবেই রাজনৈতিক ক্ষমতা ও পেশিশক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজের সম্পদ বাড়িয়ে তুলেছেন তিনি। জানা গেছে, রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় নামে-বেনামে হাজী সেলিম ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে অসংখ্য বাড়ি ও ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়া পায়রা বন্দর সংলগ্ন এলাকায় প্রচুর ভূসম্পত্তি কিনেছেন তিনি।
বিএনএনিউজ২৪/ এমএইচ