বিএনএ ডেস্ক, ঢাকা: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে একটি পপুলার ধারণা বিদ্যমান রয়েছে, তিনি বিশ্বাসই করতে পারেননি তাকে হত্যা করা হতে পারে। এই ধারণা বঙ্গবন্ধুকে মহিমান্বিত করার জন্য সত্য। কিন্তু একজন রাজনীতিক হিসেবে তার দূরদর্শিতাকে যে দুর্বল করা হচ্ছে সেটি বিবেচনায় রাখা হয় না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ১৫ আগস্ট ঘটলেও এর আগেই তাকে ন্যূনতম তিনবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে এবং সেটি তার জানার কথা। তবু তার বিদেশি শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাকে সতর্ক করলেও তিনি পাত্তা দেননি বলে আমরা জানি।
১৯৭৩ সালে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) বৈঠককালে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি নিরাপত্তার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন কাস্ট্রো। কাস্ট্রো বলেছিলেন, তোমার সামনে এখন অনেক কাজ। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। তুমি ভুলে যেও না, তোমার বিপক্ষ শক্তিও সদ্য স্বাধীন দেশে তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে। এছাড়া নিতিন কে গুকলর বই ‘আর এন কাও: জেন্টলম্যান স্পাইমাস্টার’ পড়লে জানা যায়, ১৯৭৫ সালে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র) প্রধান দায়িত্বে ছিলেন রমেশ্বর নাথ কাও। বঙ্গবন্ধু কাওয়ের কথায় গুরুত্ব দেননি। এরপর ৭৫ সালের ১২ আগস্ট তিনি আনঅফিসিয়ালি ফোন করে দ্বিতীয়বারের মতো বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেন।
মার্কিন গোয়েন্দাসংস্থার গোপন নথি, উইকিলিকস ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’র ভাষ্যগুলো দেখলে জানা যায়, ১৫ আগস্টের আগে বঙ্গবন্ধুকে তিনবার হত্যার চেষ্টা করা হয়। ১৯৭৫ সালের ২১ মে, বাসায় ফেরার পথে গ্রেনেড হামলার শিকার হন বঙ্গবন্ধু। হামলায় তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও আহত হন তার দুই সঙ্গী। সরকারের কড়া নির্দেশনার কারণে কোনো খবর প্রকাশিত হয়নি। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড বোস্টার ২৩ মে এ সম্পর্কে ওয়াশিংটনে একটি তারবার্তা পাঠান। বোস্টার হামলাকারীদের পরিচয় ও হামলার স্থান সম্পর্কে কিছু জানাতে পারেননি। বিষয়টি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালের ১৩ এপ্রিল, ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকায় এবং বাংলাদেশের ডেইলি স্টার পত্রিকায়।
এছাড়া, উইকিলিকস জানায়, ৭৪ সালের জানুয়ারিতে চীনা গোয়েন্দা সংস্থার ৬ সদস্য বাংলাদেশে আসেন। তাদের আগে থেকে বাংলাদেশে মুজিববিরোধী শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। আরমানিটোলায় এক সামরিক কর্মকর্তার বাসায় তারা ওঠেন। ২২ জানুয়ারি বিকালে শেখ মুজিব ধানমন্ডি ফেরার পথে কাকরাইল মোড়ে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। তখন তিন পথচারী মারা গেলেও বেঁচে যান বঙ্গবন্ধু।
চট্টগ্রামের বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র ’৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু উদ্বোধন করতে যান। যে মঞ্চের পাটাতনে দাঁড়িয়ে সুইচ টিপে উদ্বোধনের কথা ছিল তার নিচেই পুঁতে রাখা হয়েছিল টাইমবোমাটি। বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়া পৌঁছানোর আগেই নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা সেটিকে শনাক্ত ও নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হন। এ তথ্য ‘র’র সূত্রের বরাতে ছেপেছিল কলকাতার যুগান্তর পত্রিকা। এ বিষয়ে চলতিবছর মার্চে রাণা দাশগুপ্ত ভোরের কাগজে একটি সাক্ষাৎকারও দেন। তিনি তখন চট্টগ্রামে একটি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করতেন।
ফলে এসব হত্যাচেষ্টার ঘটনা বঙ্গবন্ধুও জানতেন সেটা অনুমান করা যায়। প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে, তিনি জানলে কেন বিদেশি বন্ধু বা সংস্থার ‘সতর্ক’ থাকার অনুরোধকে আমলে নেননি? উত্তর হতে পারে দুটো। এক, আমলে ঠিকই নিয়েছিলেন কিন্তু বিদেশিদের কাছে নিজেদের সংকট বোঝাতে চাননি। কারণ সংকট বোঝালে আখেরে এটি যে দেশের জন্য খারাপ, সেজন্যই তাদের কাছে ধরা দিতে চাননি। অন্য উত্তরটি হতে পারে, সত্যিকার অর্থেই তিনি বাংলার মানুষকে বিশ্বাস করেছিলেন। এ দুটো উত্তরই হাইপোথিসিস। তবে রাজনীতিতে প্রকাশ্যরূপের মধ্যে যে অপ্রকাশ্যরূপের হেজিমেনি থাকে সেটি বঙ্গবন্ধু হত্যার ভেতর দিয়ে আমাদের দেশের রাজনীতির চিত্রটিকেই এলোমেলো করে দিল।
মেজর ডালিম রেডিও স্টেশন দখল করে বাংলাদেশকে একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরদিন জুলফিকার আলী ভুট্টোও ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানান এবং এই ধারণা সৌদি আরবকেও দেওয়ার চেষ্টা করেন। ’৭২ সালের সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে স্থান দেওয়ায় ক্ষেপেছিলেন কট্টর ধর্মাশ্রয়ী দলগুলো। পঁচাত্তরের একুশে আগস্ট খোন্দকার মোশতাক নিজের কালো রঙের টুপিকে জাতীয় টুপি ও তার জামাকে (গলাবন্ধ ফুলহাতা আচকান বা শেরওয়ানি) সরকারি পোশাক হিসেবে ঘোষণা করেন। রেডিওতে রবীন্দ্র সঙ্গীত ও গীতা থেকে শ্লোক পাঠ বন্ধ করে দেওয়া হয়। গীতা পাঠ পরে আবার চালু করা হয়। ভাষণের শেষে জয় বাংলার বদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ ব্যবহার শুরু হয়। দেশের নাম বদলে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ করার পরিকল্পনা করা হলেও পরে বাতিল করা হয়। এই কয়েকটি প্রবণতার মধ্য দিয়েই বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধুর খুনিরা ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’-এর বিকাশ চাননি এবং তারা এটির রাজনৈতিকভাবেই বিরোধী। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আট দিনের মধ্যে সেনাবাহিনীর প্রধান হন জিয়া!
আরেকটি বিষয় ছিল বঙ্গবন্ধুর আমলে বাকশাল গঠন। এই বাকশাল গঠনকেও অনেকে দায়ী করেন। এটা সত্য, এ হত্যাকাণ্ডে বিছিন্ন সামরিক একটি শক্তির সঙ্গে বেসামরিক শক্তিরও একটা যোগসাজশ ছিল। এই শক্তি যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিরোধী সেটি না বোঝার কথা নয়। কিন্তু বাকশাল গঠনের মাধ্যমে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার অভিযোগে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে বলে যে কথা বলা হয় সেটি সত্য বলে মনে হয় না। কারণ চীনেও তখন দীর্ঘমেয়াদী একদলীয় শাসন চলছিল। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে একদলীয় শাসন চলছিল। চীনে এখনো চলছে। ব্যাপারটা হচ্ছে বাকশালী শাসন ব্যবস্থাটা কেমন সেটা বুঝলে সমস্যা নেই। বাকশালের ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমাদের প্রত্যেক বছর ৩০ লক্ষ লোক বাড়ে। আমার জায়গা হলো ৫৫ হাজার বর্গমাইল। যদি প্রত্যেক বছর ৩০ লক্ষ লোক বাড়ে তাহলে ২৫-৩০ বছরে বাংলার কোনো জমি থাকবে না চাষের জন্য। বাংলার মানুষ বাংলার মানুষের মাংস খাবে, সে জন্য আজকে আমাদের পপুলেশন কন্ট্রোল, ফ্যামিলি প্ল্যানিং করতে হবে। এটা হলো তিন নম্বর কাজ। এক নম্বর হলো দুর্নীতিবাজ খতম করুন। দুই নম্বর হচ্ছে কারখানায়-খেতে খামারে প্রোডাকশন বাড়ান, চার নম্বর হচ্ছে জাতীয় ঐক্য।’ তো, সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশটির জন্য তো এ জাতীয় ঐক্য দরকার ছিল। কিন্তু এটাকে নিয়ে অপপ্রচার চালালেন কট্টর ইসলামিক শক্তি ও চীনাপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি দাবিকারী দলগুলো। জাসদ যেমন বিরোধিতা করেছে। জামাতও বিরোধিতা করেছে।
অন্যদিকে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ ছিল কৃত্রিমভাবে তৈরি। অর্থনৈতিকভাবে আমেরিকা ও চীন দু দেশই সাহায্য করা দূরের কথা, বরং তাদের মিত্রদেশগুলোকে সাহায্য না করার আহ্বান জানিয়ে আসছিল। যা গার্ডিয়ান পত্রিকার সাংবাদিক ফিলিপ রড্রিকস ১৯৭৫ সালের ১৭ অক্টোবর সংখ্যায় লিখেছিলেন। অবশ্য বঙ্গবন্ধু দুর্ভিক্ষের দায়ভার নিয়ে কোনো ভণিতা করেননি। জাতীয় সংসদে দুর্ভিক্ষে প্রাণহানির সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে ত্রিদেশীয় চুক্তির ফলে দেশকে একটা স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে যেতে।
সে সময় আরও একটি ঘটনা রটেছিল বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামাল ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়েছিলেন, যা একটা মিথ্যা প্রচারণা। পরে প্রমাণিত হয়েছে—শেখ কামাল লুটপাট হচ্ছে শুনে তার বন্ধুদের নিয়ে গাড়িতে চড়ে মতিঝিলের দিকে যাওয়ার পথে পুলিশ কামালকে না চিনে গুলি করলে শেখ কামাল নিরাত্তার স্বার্থে গুলি ছুড়েছিলেন। সেই ছবি এক ফটোগ্রাফার তুলে ফেলেন। কিন্তু শেখ কামাল লুটপাট ঠেকাতে যাচ্ছিলেন। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ কামালের সঙ্গে তিনদিন কথা বলেননি অভিমানে। তার ছেলে কেন বেআইনিভাবে যাবে লুটপাট ঠেকাতে, সেটাই ছিল অভিমানের কারণ। এ নিয়ে পরে বিবিসি প্রতিবেদন করেছিল। দেশেও পরে জাতীয় পত্রিকায় নিউজ হয়েছে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা এসব মিথ্যা গুঞ্জনকে কাজে লাগিয়েছিল। আমেরিকান দূতাবাসে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য ফারুক রশিদ গিয়েছিলেন বোস্টারের কাছে। সেসব অজানা ছিল। গোপন ছিল। ষড়যন্ত্র গোপনীয়তাই পছন্দ করে। এই বঙ্গবন্ধুই এক ভাষণে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কথা ‘রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি। এর মানে তিনি শুধু বাঙালিও থাকতে চাননি। যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরোধী তারা অমানুষের মতো হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমেদে এক প্রবন্ধে লিখেছেন, এমনকি ভারতও সেসময় নীরব ছিল। কারণ প্রতিবেশি দেশেই বঙ্গবন্ধুর মতো এরকম একটা ইমেজ বিল্ডআপ হচ্ছে, এটা ভারত সহ্য করেনি। তারা বাংলাদেশের ওয়াইসিতে যাওয়াটাও পছন্দ করেনি। তাদেরও ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। আইএসআই, মোসাদ, সিআইএ সবাই ষড়যন্ত্র লিপ্ত ছিল। যার ফলাফল স্বাধীন বাংলাদেশকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। এরই কারণে ঘটেছে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড।
বঙ্গবন্ধু কি টের পেয়েছিলেন তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র চলছে? নাকি জানতেনই না? ভারতীয় লেখক নিতিন কে গুকলের লেখা এবং হারপার্লস পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত ‘আর এন কাও: জেন্টলম্যান স্পাইমাস্টার বইটি পৃষ্ঠা ৮৫-৮৬ পড়লে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু টের পেয়েছিলেন যে, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে এবং খোন্দকার মোশতাক থেকে সাবধানও থাকতে বলেছিলেন দলের সিনিয়র নেতাদের। কিন্তু তাকে যে হত্যা করা হবে সেটা ভাবতেও পারেননি। ১৯৭৫ সালে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র) প্রধান দায়িত্বে ছিলেন রমেশ্বর নাথ কাও। তাকে কথা প্রসেঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমি যে দেশের জন্য দিনের পর দিন জেল খেটেছি। লড়াই করে দেশ স্বাধীন করেছি। তারা তো বাঙালি। বাংলা ভাষায় কথা বলে। তারা আমাকে হত্যা করবে এটি আমি ভাবতেও পারি না। যদিও আমাকে সাবধান করছেন।”
রমেশ্বর নাথ কাও সেসময় বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চান, “তাহলে আপনাকে অতীতে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে সেগুলো?” জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “সেগুলি কেন হচ্ছে সত্যি আমি জানি না।” শেখ মুজিব একথা বলে একটু উদাস হয়ে গেলেন। আর এন কাও কী আর বলবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না।
বিএনএনিউজ২৪/ এমএইচ