পশ্চিমা দেশ ও মিডিয়াগুলো যেভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে বলে বেড়াচ্ছে যে, ইউক্রেন সংকটের কারণে সারাবিশ্বেই খাদ্য সংকট বা দুর্ভিক্ষ আসন্ন, তাতে মনে হতে পারে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে যেতে পারে।
জাতিসংঘ সহ অন্যান্য বিশ্ব-সংস্থা, পশ্চিমা-বিশ্ব এবং মিডিয়াগুলো একযোগে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে যে বিশ্বে খাদ্যসংকট বা দুর্ভিক্ষ আসন্ন । বলাহচ্ছে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এর পর এবারই বিশ্ব সর্বোচ্চ খাদ্য সংকটের মুখোমুখী হতে যাচ্ছে। তারা এটাও বলছে যে, এই খাদ্য-সংকটে’র কারণ ইউক্রেন-যুদ্ধ এবং ইউক্রেন থেকে খাদ্য রপ্তানিতে রাশিয়া’র বাধা প্রদান করা।
যেভাবে ঢাক-ঢোল পিটানো হচ্ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে যে বিশ্বে একটা খাদ্য সংকট তৈরি হতে যাচ্ছে, তাতে কোনই সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে
* সেই খাদ্য সংকট কি ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তৈরি হতে যাচ্ছে ?
* রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেনের রপ্তানিতে বাঁধা প্রদানের কারণে হতে যাচ্ছে ?
* না কি বিশ্বের প্রভাবশালী দেশসমূহের মেকানিজমে এই সংকট তৈরী হতে যাচ্ছে ?
* ভারতই বা কেন হটাৎ করে তাদের উত্বৃত্ত গম বিক্রি বন্ধ করে দিল ?
প্রসঙ্গ-হীন-ভাবে হেনরী কিসিঞ্জারের একটি উক্তি উধৃত করে রাখছি, যা পরে প্রাসঙ্গিক মনে হতেপারে~
“Control Oil and you control nation”.
“Control food and you control the people”.
গত কয়েকদিনের বিশ্ব-মিডিয়া গুলোতে প্রচারিত সংবাদের দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, এই আসন্ন খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষের খবর ইউক্রেন যুদ্ধকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। কয়েকদিন আগে অনুষ্ঠিত হাওয়া G-7 ভুক্ত ধনী-দেশগুলোর সম্মেলন থেকেও এবিষয়ে আগাম সতর্ক বার্তা দেয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা(FAO) সহ সকল বিশ্বসংস্থাগুলো এই খাদ্য সংকট নিয়ে সোচ্চার হয়েছে, সকলেই একযোগে বলে যাচ্ছে যে~ ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে এই ভয়াবহ খাদ্য সংকটের সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, এর ফলে শুধু ইউক্রেন নয় বরং হাজার হাজার মাইল দূরের দেশ সমূহের মানুষেরও মৃত্যু ঘটবে, যার অন্যতম কারণ ইউক্রেন যুদ্ধ। জাতিসংঘের প্রধান সহ সকলেই যেন বলতে চাচ্ছে এর জন্য দায়ী রাশিয়া তথা “পুতিন” । আরো স্পেসিফিক ভাবে বলা হচ্ছে যে, রাশিয়া ইউক্রেনের বন্দরগুলো দখল বা আটকে রাখার কারণে ইউক্রেন গম ও সূর্যমুখী তেল রপ্তানি করতে পারছে না বিধায়; এই সংকট বা দুর্ভিক্ষ হতে যাচ্ছে।
বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা সংস্থার মুখপাত্র ইথিওপিয়ার বংশোদ্ভূত “সারা–” সম্প্রতি বলেছেন যে, বিশ্বে আর মাত্র ১০ সপ্তাহ চলার মত গম মজুদ আছে, এরপর দুর্ভিক্ষ আসন্ন।
উল্লেখ্য; এই যুদ্ধের আগে থেকেই শ্রীলংকা, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, সিরিয়া, লেবানন, ও লিবিয়াসহ আফ্রিকার অনেক দেশেই খাদ্য সংকট চলে আসছে। অনেক আগে থেকেই এইসব দেশগুলোতে অর্ধাহারে/অনাহারে দিনাতিপাত করে যাচ্ছে লাখ লাখ শিশুসহ অসংখ্য মানুষ। সম্প্রতি এই লিস্টে যুক্ত হয়েছে ইরাক, মিশর, পার, ও যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের কিছু দেশ।
কিন্তু কেনো এত-দ্রুত এই সংকটগুলি তৈরী হচ্ছে , সে বিষয়ে জানার আগে আমাদের বিগত বছর গুলোর কিছু পরিসংখ্যান জানা থাকা দরকার ।
আসুন দেখে নেই কিছু পরিসংখ্যান:
* জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা “FAO” এর মতে বিশ্বের মানুষের জন্য যে পরিমাণ খাদ্যের প্রয়োজন হয়, প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় তার দেড়গুণ (কিছু কম/বেশি মিলিয়ে গড়ে) খাদ্য উৎপাদিত হয়।
বহুবছর যাবত এভাবেই বিশ্বে খাদ্য উৎপাদিত হয়ে আসছে, কিন্তু প্রতিবছর এই খাদ্যের এক-তৃতীয়াংশ নষ্ট করা হচ্ছে বা নষ্ট হয়। সবথেকে বেশি খাদ্য নষ্ট হয় সৌদি ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো সহ ইউরোপ ও আমেরিকায়।
* FAO এর আরেকটি রিপোর্টে বলা হচ্ছে, গত ৭ বছরে বিশ্বে যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, তার চেয়ে বেশি হারে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।
* আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংস্থা (OECD) এর মতে~ ১৯৬০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল ৩ বিলিয়ন যা ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৭.৮ বিলিয়ন।
অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২.৬ গুণ । অথচ ১৯৬০ সালে বিশ্বে যে পরিমাণ খাদ্য উৎপাদিত হয়েছিল, ২০২১ সালে এসে তা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩.৩২ গুণ। অর্থাৎ গত ৬০ বছরে ২.৬ গুণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিপরীতে খাদ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৩.৩২ গুণ। অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক বেশি।
এখন যদি জিজ্ঞেস করি, গত ৬০ বছরে অর্ধাহারে, অনাহারে যত মানুষ মারা গিয়েছে, তার দায়ভার কার ? জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাইতেও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি বেশি হওয়ার পরও এত মানুষ অনাহারে থাকলো কেন,
শিশু ও বৃদ্ধ সহ এত মানুষ খাদ্যের অভাবে মৃত্যুবরণ করলো কেন ?
যেসমস্ত দেশে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদিত হয়েছিল, তারা কি খাদ্য ঘাটতির দেশ-সমূহে উক্ত অতিরিক্ত খাদ্য নিয়ে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ?
এই সময়ের মধ্যে সবথেকে বেশি যুদ্ধ হয়েছিল এবং যুদ্ধগুলো কারা বাধিয়েছিল, আমরা সকলেই জানি।
এসব যুদ্ধের কোনোটিই কি খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে বাধা হয়েছিল ?
ইয়েমেন, সিরিয়া, আফগানিস্থান, লেবাননসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের শিশুসহ লোকজন তাহলে কেন না খেয়ে মারা গেলো ?
করা গৃহযুদ্ধ বা যুদ্ধ এবং অবরোধ চাপিয়ে দিয়ে এইসব দেশে খাদ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছিল ?
আজকে যেসব সংস্থা বা দেশ বা বিশিষ্ঠ ব্যক্তি আসন্ন খাদ্য সংকট কে উধৃত করে রাশিয়া বা পুতিনকে দায়ী করে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে বেড়াচ্ছেন, তারা কি ইয়েমেনে লাখ লাখ শিশু ও মানুষের খাদ্য ঘাটতির জন্য সৌদি আরব ও আরব আমিরাতকে দায়ি করে সেসময় এরূপ বক্তৃতা ও বিবৃতি দিয়েছিলেন ? অথবা সেসময় নিজ দেশের উদ্বৃত্ত খাদ্য নিয়ে ইয়েমেনের পাশে সহায়তার হাত বাড়িয়েছিলেন ? তাহলে ইয়েমেনে এত মানুষ অনাহারে ও অর্ধাহারে থাকলো কেন ?
আফগানিস্থান ও সিরিয়ায় খাদ্য সংকট নিয়ে আমেরিকাকে দায়ী করে একবারও বক্তৃতা ও বিবৃতি দিয়েছিলেন ?
এখনও আফগানিস্থানে মানুষ ঘাস ও লতাপাতা সিদ্ধকরে খেয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে, অথচ আমেরিকান ব্যাংকে আফগানিস্থানের কয়েকশত বিলিয়ন ডলার বাজেয়াপ্ত করে রাখা হয়েছে; আপনারা কেউ কি সে অর্থ ছার করার মাধ্যমে আফগানদের জীবন বাঁচাতে আমেরিকার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন ? শ্রীলংকা, লেবানন, লিবিয়া ও আফ্রিকা সহ অন্য দেশের উদাহরণ আর নাই বা দিলাম।
আমরা ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্য বাজারজাত করতে না পারার জন্য পুতিনকে অবশ্যই দায়ী ভাবি, এবং তার নিন্দাও জানাই, সাথে উপরোক্ত দেশগুলোতে খাদ্য ঘাটতির জন্য দায়ী দেশসমূহেরও নিন্দা জানাই। আমরা চাই আপনারাও সেসব ক্ষেত্রে সোচ্চার হউন। উদ্যেশ্য প্রণোদিত ভাবে একপেশে আচরণ বা নীতি আমরা গ্রহণ করতে পারি না।
তাছাড়া শুধুমাত্র ইউক্রেনের উৎপাদিত পণ্যের অভাবে কি বিশ্বে এধরনের খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে ? বিশ্বের অন্যতম খাদ্য উৎপাদন কারী দেশ রাশিয়ার খাদ্য বিশ্ববাজারে আসতে দিচ্ছে না কে বা কারা ? ইউক্রেনের চাইতে অনেকগুণ বেশি খাদ্য উৎপাদিত হয় রাশিয়ায়, তাহলে রাশান খাদ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছেন কেন ? আসন্ন খাদ্য ঘাটতি মেটাতে রাশান ও ইউক্রেনীয় খাদ্য যদি যথেষ্ঠ মনে করেন আপনারা, তাহলে রাশিয়াকে বলুন~ আমরা তোমার খাদ্য বিশ্ববাজারে বিক্রি করতে দিব যদি তুমি ইউক্রেনে মজুদ থাকা খাদ্যও বিশ্ববাজারে বিক্রির সুযোগ দাও~ দেখবেন রাশিয়া এক লাফে রাজি হয়ে যাবে, রাশিয়া তো ইউক্রেনের খাদ্য বিক্রিতে বাধা দিচ্ছেই তাদের উপর থেকে খাদ্য নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য করার জন্য। সমাধানের দিকে না তাকিয়ে অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে নিজেদের দায়ভার কতটুকু এড়ানো যায় এযুগে ?
আসুন আরও কিছু পরিসংখ্যান জেনে নেই~
গড়ে দৈনিক একজন মানুষ প্রায় ১ কেজি ৪০০ গ্রাম খাবার খায় অর্থাৎ বছরে গড়ে ৫১১ কেজি খাবার খায়।
বিশ্বের বর্তমান জনসংখ্যা ৭.৮ বিলিয়ন, উপরোক্ত হিসেবে বিশ্বে সকল মানুষের পেট ভরে খাবারের প্রয়োজন ৪ বিলিয়ন মেট্রিক টন।
FAO এর তথ্যমতে ২০২০ সালে বিশ্বে খাদ্য উৎপাদিত হয়েছিল প্রায় ৫ বিলিয়ন মেট্রিক টন, ধরে নেই এই উৎপাদিত খাদ্যের এক-তৃতীয়াংশ নষ্ট করা হয়েছিল। তারপরও বাকি যে পরিমাণ খাদ্য মানুষ সেসময় খাওয়ার কাজে ব্যবহার করেছিল, তা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার জন্য যথেষ্ঠ ছিল।
FAO এর আরেকটি রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে ২০ থেকে ৩০ গুণ খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু জনসংখ্যা তো আর এই পরিমাণ বৃদ্ধি পায় নি।
উপরের হিসাবগুলো দিয়ে আসলে আমি এটাই বুঝাতে চাচ্ছি যে, প্রতিবছর বিশ্বে যত খাদ্য উৎপাদিত হয় বা হয়েছিল, তা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার তুলনায় যথেষ্ঠ ছিল।
তাহলে বিগত বছর গুলোতে কেন কোটি কোটি মানুষ অর্ধাহারে বা অনাহারে থেকেছে ?
এখনও কেন বিশ্বে প্রায় ২০ কোটি মানুষ প্রতিদিন অর্ধাহারে/অনাহারে দিনাতিপাত করছে এবং দিন দিন কেন এই সংখ্যাটি বৃদ্ধি পাচ্ছে ?
একদিকে যেমন দিন-কে-দিন খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি অনাহারে/অর্ধাহারে থাকা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কিন্তু কেন ? ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ? ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়েছে মাত্র ৪ মাস হয়, আর উপরের পরিসংখ্যান-গুলো প্রায় ৬০ বছর আগ থেকে বর্তমান পর্যন্ত।
আর যাই হোক ইউক্রেন যুদ্ধ তো আর ৬০ বছর আগ থেকে শুরু হয় নি ? অবশ্য জেলেনস্কির মত মিথ্যুক সরকার প্রধান আর পশ্চিমা মিডিয়া যেকোন সময় সেটিও বলতে পারে~
সম্প্রতি আমি খবরে মি: জেলেনোষ্কির একটি বিবৃতি দেখেছিলাম, তিনি বলছিলেন ইউক্রেনে সংরক্ষিত থাকা প্রায় ২.৫ কোটি মেট্রিক টন গম রাশিয়ার কারণে বিক্রি করতে পারছেন না তিনি, যার কারণে বিশ্বে তৈরী হতে যাচ্ছে ভয়াবহ খাদ্য সংকট।
মূলতঃ মিডিয়ার এই রিপোর্টটি-ই আমাকে এসংক্রান্ত খোঁজখবর করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং আমি উপরক্ত তথ্য উপাত্বসহ আরও কিছু তথ্য উপাত্ত জানতে পারি, যা নিম্নরূপ~
* যুদ্ধের শুরু থেকেই পশ্চিমা মিডিয়া ফলাও করে বলে আসছে ইউক্রেন ইউরোপের শস্যভাণ্ডার, বিশ্বের প্রায় ৩০% গম উৎপাদন হয় ইউক্রেন ও রাশিয়ায়, সূর্যমুখী তেলের কথা আর নাই বা বললাম। বলা হচ্ছে প্রায় ২০ মিলিয়ন মেট্রিকটন গম ইউক্রেনের মাঠে পড়ে আছে, যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনীয় কৃষক তা ঘরে তুলতে পারছে না। ইউক্রেনের সমুদ্র বন্দর গুলোতে আটকা পরে আছে আরও ৪.৫ মিলিয়ন টন কৃষি পণ্য যা রাশিয়ার অবরোধের কারণে পরিবহন করা যাচ্ছে না। যদি রাশিয়া আগ্রাসন না চালাতো তাহলে এসব খাদ্য ও পণ্য দিয়ে বিশ্বের আসন্ন খাদ্য-সংকট মোকাবেলা করা যেত।
মূলতঃ পশ্চিমা মিডিয়া গুলো এরূপ প্রচারণাই চালিয়ে যাচ্ছে।
উপরের তথ্য গুলো কতটুকু সত্য ? আপনারাই বিচার করে দেখুন~
FAO এর মতে, গতবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যে পরিমাণ গম উৎপাদন করেছে তা নিম্নরূপ~
১).ইউরোপীয় ইউনিয়ন~ ১৩৬.৫০০ মিলিয়ন মে: টন।
২).চীন~১৩৫.০০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন।
৩).ভারত~ ১০৮.০০০ মিলিয়ন মে: টন।
৪).রাশিয়া~ ৮০.০০০ মিলিয়ন মে:টন।
৫).যুক্তরাষ্ট্র ~৪৭.০৫০ মিলিয়ন মে: টন।
৬). কানাডা~ ৩৩ .০০০মি: মে: টন।
৭). অস্ট্রেলিয়া~৩০.০০০ মি: মে: টন।
৮).পাকিস্তান~ ২৬.০০০ মি: মে:টন। এরপর
৯).ইউক্রেন~ ২১.৫০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন।
(পরের হিসাবগুলো আর উধৃত করলাম না )
অর্থাৎ গম উৎপাদনে বিশ্বে রাশিয়া ৪ নম্বর এবং ইউক্রেন ৯ নম্বর দেশ।
FAO এর তথ্যমতে গতবছর বিশ্বে মোট গম উৎপাদিত হয়েছে ৭৭৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন।
অর্থাৎ গতবছর বিশ্বের মোট গম উৎপাদনের মাত্র ২.২৬৭% গম উৎপাদন হয়েছিল ইউক্রেনে আর রাশিয়ায় মাত্র ১০.২৯% অর্থাৎ রাশিয়া ও ইউক্রেনে মিলিত ভাবে গতবছর গম উৎপাদিত হয়েছিল বিশ্বের মোট উৎপাদনের মাত্র ১৩.০৫৭% ভাগ।
তাহলে পশ্চিমা মিডিয়ায় কেন বলা হচ্ছে যে রাশিয়া ও ইউক্রেনে বিশ্বের ৩০% এর বেশি গম উৎপাদিত হয়?
মাত্র ২.২৬৭ ভাগ উৎপাদন কারী ইউক্রেন-কে কেন বলা হচ্ছে ইউরোপের শস্য ভান্ডার ?
মাত্র ২১.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন গম উৎপাদন-কারী দেশের (ইউক্রেন) রাষ্ট্রপ্রধান কেন বলছে যে তাদের দেশে ২.৫ কোটি মেট্রিকটন গম বিক্রির জন্য মজুদ আছে ? কোন দেশ কি উৎপাদনের চাইতে মজুদ বেশি করে ?
ধরে নিলাম ইউক্রেনের জনগন না খেয়ে গতবছর তাদের উৎপাদিত সমস্ত গমই মজুদ করে রেখেছে, এবং
এবং রাশিয়া তা বিক্রি করতে দিচ্ছে না~ তারপরও কি বিশ্বে খাদ্য ঘাটতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ? যেখানে প্রতিবছর ৩০ ভাগের বেশি খাদ্য নষ্ট করা হয়, সেখানে ইউক্রেনে উৎপাদিত ২.২৬৭ ভাগ খাদ্য আটকে দেয়ার জন্য কি পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ হতে পারে ?
উত্তর: হ্যা তারপরও পৃথিবীতে খাদ্য সংকট এবং দুর্ভিক্ষ হতে পারে, যদি অসম-বণ্টনের মাধ্যমে বা কিরিঞ্চি করে বা ষড়যন্ত্র করে ধনীদেশগুলো প্রয়োজনের অনেক বেশি পরিমাণ খাদ্য মজুদ করে রাখে এবং তা বাজারে আসতে না দেয়~ তাহলে উৎপাদনে পিছিয়ে থাকা দেশসমূহে খাদ্য সংকট বা খাদ্য ঘাটতি বা দুর্ভিক্ষ হতেই পারে।
পশ্চিমা বিশ্বের ঢাক-ঢোল পেটানো দেখে বিশেষজ্ঞরা ধরেই নিয়েছে এবছর খাদ্য সংকট বা দুর্ভিক্ষ ঘটানো হবে~
কিন্তু কেন কৃত্রিম ভাবে দুর্ভিক্ষ ঘটানো হবে ? তাতে কি লাভ তাদের ?
এখন আসি হেনরী কিসিঞ্জারের সেই বিখ্যাত উক্তিতে~নিম্নরূপ:
“Control Oil and you control nation”.
“Control food and you control the people”.
তিনি আরও বলে গেছেন~ “খাদ্যশস্য ও বীজের উপর কন্ট্রোল থাকা বন্দুক ও বোমা থাকার চাইতেও উত্তম।
খাদ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হলো মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সবথেকে ভালো পদ্ধতি”।
ইউক্রেনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সরবরাহ করে এবং ইতিহাসের ভয়াবহ অবরোধ দিয়েও যখন রাশিয়া এবং তার মিত্রদের বাগে আনা যাচ্ছে না, তখন খাদ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, কৃত্রিম খাদ্য সংকট ঘটিয়ে তাদের বাগে আনার বিকল্প কি কিছু হতে পারে ?
মূলতঃ বিষয়টি বুঝতে পেরেই জলবায়ু পরিবর্তনের মত একটি অযৌক্তিক কারণ দ্বার করিয়ে ভারত তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রায় ১ কোটি মেট্রিক টন গম বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
আমি মিডিয়াতে একজন ভারতীয় কর্মকর্তা(,নাম মনে নেই)কে বলতে শুনেছি, ” এখন যদি গম বিক্রি চালু রাখি, তাহলে ইউরোপ বেশি দামে সব গম কিনে ফেলবে, আমরা আপদকালীন সময়ে পার্শ্ববর্তী দেশসহ দরিদ্র দেশগুলোর খাদ্য নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে গম বিক্রি বন্ধ রেখেছি”। এই আপদকালীন সময়টা বলতে উনি আসন্ন খাদ্য সংকট বা দূর্ভিক্ষকেই বুঝিয়েছেন। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে বিশ্বের অনেক দেশই তাদের অতিরিক্ত খাদ্য ও দ্রব্য বিক্রিতে নিয়ন্ত্রণ বা কড়াকড়ি আরোপ করেছে বা করতে যাচ্ছে, ফলে সংকট আরও দ্রুত ঘনীভূত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা কি বিষয়টি বুঝতে পেরেছে ? ভারতের মতো কি এ-জন্য আগাম কোন প্রস্তুতির কথা ভাবছে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের রাজনীতিবিদেরা ?
আমি বিশ্বাস করি- আর কেউ না ভাবলেও জননেত্রী শেখ হাসিনা ঠিকই কিছু না কিছু ভেবে রেখেছেন, এখন হয়তো আমরা তা বুঝতে পারছি না, কিন্তু সংকটকালীন সময়ে আমরা তা ঠিকই বুঝতে পারবো।
লেখক :: আজিজ মিশির সেলিম, সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ,চুয়েট।
সাধারণ সম্পাদক, চুয়েট ছাত্রলীগ এ্যালামনাই এসোসিয়েশন।
( বিএনএনিউজ২৪ ডটকম এর মতামত,মন্তব্য ক্যাটাগরিতে প্রকাশিত কোন লেখার জন্য সম্পাদক বা প্রকাশক কেউ দায়ী নন, এটি লেখকের নিজস্ব মতামত)