বিএনএ, ঢাকা : শিরোনাম দেখে চমকে ওঠেছেন! এ কেমন সংবাদ শিরোনাম? না, নিছক রশিকতা করতে এমন সংবাদ শিরোনাম করা হয়নি। সংবাদের বিষয় বস্তুর কারণে এমন শিরোনাম হয়েছে ।শুরুতে আসা যাক ‘নবাব’ শব্দ নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা, পরে থাকছে ‘ নবাব’ রূপধারণের পরিণতির বিষয়টি।
‘নবাব’ শব্দটি শুনলে প্রথমে ভেসে আসে মাথায় পাগড়ি- মুকুট, গলায় পুতির মালা, হাতে দামি আংটি, কোমরে তলোয়ার এবং গায়ে ঝলমলে আফগানি পোশাকে একজন শাসকের চেহারা। বাংলার শেষ নবাব ছিলেন মনসুর আলী খান। ১৮৮০ সালের ১লা নভেম্বর তাকে পদত্যাগে বাধ্য করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তার পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে ‘নবাব’ উপাধি বিলুপ্ত করা হয়। তারপরও সাধারণ মানুষ তাদের সন্তানদের আদর করে নাম রাখতেন ‘নবাব’।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী মোহনার কাছাকাছি উত্তর বন্দর গ্রামের তরমিয়ত খান নামে এক চা দোকানি তার দ্বিতীয় পূত্রের নাম রাখেন ‘নবাব খান’। সেই নবাব খানই এখন ‘টক ‘অব দ্য কান্ট্রি। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) এর ইউরিয়া সার পরিবহন ঠিকাদার নবাব খান আত্মসাৎ করেছেন ৬২০ কোটি টাকা। শুধু তাই নয় বিসিআইসি মামলা করার পর আদালতে নিজের পরিচয়ে ভাগিনাকে উপস্থাপন করে জামিন নেয়ার চেষ্ঠা করেছেন! কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
ধরা খেয়ে ভাগিনা ফাহিম আহমেদ কারাগারে। আর নবাব খান পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। চেষ্ঠা তদবির করছেন বিদেশ পাড়ি দেয়ার! আদালত সূত্র জানায়, ৬২০ কোটি টাকার সার আত্মসাৎ মামলার আসামী নবাব খান রূপধারণ করে তার ভাগিনা ফাহিম আহমেদকে আদালতে উপস্থাপন মামলায় ৫ জনকে আসামী করা হয়েছে। মামলায় নবাব খান, তার ভাগিনা ফাহিম আহমেদ ছাড়াও নবাব খানের নিযুক্ত তিনজন আইনজীবীকে আসামী করা হয়েছে। এরা হলেন এ্যাডভোকেট দেব দুলাল দাস (সদস্য নং-১০৮৪), অ্যাডভোকেট আনোয়ার ইসলাম চৗধুরী, অ্যাডভোকেট আফরোজা খাতুন।
মামলার অপর দুই আসামী হচ্ছেন, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদস্থ নবাব এন্ড কোম্পানির মালিক নবাব খান এবং তার ছোট বোনের ছেলে (ভাগিনা) ফাহিম আহমেদ।আদালত কারাগারে আটক ফাহিম আহমেদ ছাড়া ৪ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। বাতিল হয়ে যাবে তাদের আইনজীবী সমিতির সদস্য পদ।
গত ২২ ফেরুয়ারি ঢাকার সিএমএম কোর্টের নাজির রেজোয়ান খন্দকার কোতোয়ালী থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলা নং ২৭, তারিখ ২২/০২/২০২২ দায়ের করেন। ধারা ৪১৯/৪৬৮/৪৭১ পেনাল কোর্টের ১৮৬০ (অপরের রূপ ধারণ পূর্বক প্রতারণামূলক ভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে জাল স্বাক্ষর করত: তা খাটি হিসেবে ব্যবহার করার অপরাধ)। মামলায় সিএমএম কোর্ট ঢাকা এর নাজির মো: রেজোয়ান খন্দকার উল্লেখ করেন, সিএমএম কোর্ট ঢাকা বিজ্ঞ চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-১, ঢাকার আদেশ নম্বর ০৪ তারিখ ২২/২/ ২০২২ খ্রি: স্বারক নং ৪২৭৬১ মূলে জানায় যে, ২২/২/২০২২ আনুমানিক ১২:১৫ ঘটিকার সময় মতিঝিল থানার মামলা নম্বর-৪১ (১২)২১ এর আসামী নবাব খান (৪৭) পিতা মৃত তবিয়ত খান, মাতা সুলতানা বেগম সাং : উত্তর বন্দর, থানা: কর্ণফুলী, জেলা: চট্টগ্রাম এর পরির্বতে গ্রেফতারকৃত আসামী ফাহিম আহমেদ, (২৫) বিজ্ঞ সিএমএম এর (১ নং) আদালতে আত্মসমর্পণ পূর্বক জামিন আবেদন করেন।
ডিএমপির মতিঝিল থানার জিআরও এসআই শওকত আকবর একখানা দরখাস্তের মাধ্যমে বিষয়টি সিএমএম মহাদয়কে লিখিতভাবে অবহিত করেন। ১ নম্বর আসামী ফাহিম আহমেদ বিজ্ঞ আদালতে জবানবন্দি প্রদান পূর্বক ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। ২ নম্বর আসামী নবাব খান ও তার সংশ্লিষ্ট আইনজীবী ৩ নম্বর আসামী এ্যাডভোকেট দেব দুলাল দাস, ৪ নম্বর আসামী এ্যাডভোকেট মো: আনোয়ারুল ইসলাম, ৫ নম্বর আসামী এ্যাডভোকেট আফরোজা খাতুনের কুপরামর্শে ১ নম্বর আসামী ফাহিম আহমেদ, ২ নম্বর আসামী নবাব খান এর রূপ ধারণ করিয়া প্রতারণামূলকভাবে বিজ্ঞ আদালতে আত্মসর্মাপন করেন।
ওকালতনামা ও জামিন আবেদনে জাল স্বাক্ষর প্রদান করেন। যা দন্ডবিধির৪১৯/৪৬৮/৪৭১ ধারায় অপরাধ। এ মামলায় আসা্মীদের ৭ বছর কারাদন্ড হতে পারে। মামলায় ফাহিম আহমেদ এর বয়স ২৫ বছর উল্লেখ করা হয়েছে। অপর দিকে নবাব খানের বয়স (৪৭)। আদালতে মোহাম্মদ নবাব খান, পিতা মৃত তরবিয়ত খান, মাতা মৃত সুলতানা বেগম নামে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র দাখিল করা হয়েছে।যার নং ১৫১০৪১৯৮০৭৮৪৪। এতে জন্ম তারিখ উল্লেখ আছে ০৩ জুন ১৯৬৫। সে হিসাবে নবাব খানের বয়স ৫৭ বছর।
মতিঝিল থানায় দায়ের করা মামলায় বলা হয়, ২০১৯-২০২০ ও ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) এর মাধ্যমে আহ্বানকৃত টেন্ডারের বিপরীতে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) বিভিন্ন দেশে থেকে ইউরিয়া সার আমদানি করে থাকে। আমদানীকৃত ইউরিয়া চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বাফার গুদামে পৌছে দিতে নবাব এন্ড কোম্পানির সঙ্গে ভিন্ন ভিন্নভাবে ৭টি চুক্তি করে বিসিআিইসি।
৫০ দিনের মধ্যে এ সার পৌছে দেয়ার কথা। বিসিআইসি জি টু জি চুক্তির মাধ্যমে মধ্য প্রাচ্যের মুনতাজাত- কাতার ও সাবিক সৌদি আরব ১,৮৩,১৫৬.৫৫ ইউরিয়া সার আমদানি করে। এর মধ্যে কাতার থেকে এমভি জিন্দা জাহাজ যোগে আনা ইউরিয়া সার ৬/২/২০২০ খালাস শেষ হয়।কাতার থেকে আসা এমভি গোল্ডেন লিফ-১ জাহাজ আনা সার খালাস হয় ১১/১১/২০২০।
একই সময়ে এমভি সি বেনিভোলেন্স সৌদি আবর থেকে আমদানী করা ইউরিয়া সার নিয়ে আসে। ২১/১২/২০২০ সার নিয়ে আসে এমভি বাংলার অরজুন সৌদি আবর থেকে । এমভি গোল্ডেন লিফ-২ জাহাজটি সৗদি আরব থেকে সার নিয়ে আসে ২৪/১২/ ২০২০। পরের বছর ১৬/২/২০২১ সৌদি আবর থেকে আমাদানি করা সার নিয়ে আসে এমভি প্যাসিফিক ভিক্টর। ১৯/২/২০২১ সালে আসে এমভি ইমালা।
উল্লেখিত ৭টি জাহাজে বিসিআইসি আমদানি করা ১,৮৩,১৫৬.৫৫ মেট্রিক টন সার পরিবহন করে নবাব এন্ড কোম্পানি। এর মধ্যে বিসিআিইসিকে ৬৬৮৭৪ মেট্রিক টন আমদানি করা ইউরিয়া সার বুঝিয়ে দেয়নি।উক্ত সারের আনুমানিক মূল্য ৭২,২১৭,২৩২.৬০ মার্কিন ডলার। যা বাংলাদেশি ৬১৯৯৮৪৯৪১৯ ( ছয়শত উনিশ কোটি আটানব্বই লাখ উনপঞ্চাশ হাজার চারশত উনিশ) টাকা। বিসিআইসিকে ৬৬৮৭৪ মেট্রিক টন সার বুঝিয়ে দে ৫/৮/২০২১, ২৪/৮/২০২১, ২৫/১০/২০২১, ৩/১১/২০২১ খ্রি: আসামী নবাব খান (৫৫)কে তাগিদপত্র দেয়া হয়। ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর সময় সীমা বেধে দেয়া হয়। কিন্তু নবাব খান তা আমলে নেয়নি।এতে রাষ্ট্রের স্বার্থ মারাত্বকভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে এবং কৃষক সারের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে বিসিআইসির উপ ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলামের মতিঝিল থানায় দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়।
মামলা নং ৪১ (১২)২১। তারখি ২৩/১২/২০২১ ধারা ৪২০/৪০৬ দন্ডবিধি। এ মামলা দায়ের হওয়ার পর গত ৩ ফেরুয়ারি মহামান্য হাইকোর্টে ক্রিমিনাল মিস মামলা নং ৬২৬৯ /২০২২ করে আগাম জামিনের আবেদন করেন। নবাব খানের পক্ষে ছিলেন এ্যাডভোকেট চঞ্চল কুমার দত্ত। বিচারপতি মুহাম্মদ আব্দুল হাফিজ, বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর দ্বৈত বেঞ্চ তিন সপ্তাহের আগাম জামিন দেন এবং নিম্ম আদালতে হাজির হওয়ার আদেশ দেন। হাইকোর্টের আদেশের ভিত্তিতে নবাব খান তার ভাগিনা ফাহিম আহমেদকে নবাব খান সাজিয়ে উপস্থাপন করেন। তার আইনজীবী এ্যাডভোকেট দেব দুলাল দাস জামিনের বিষষটি নিশ্চিত করে মোটা অংকের টাকা গ্রহণ করেন।কিন্তু রহস্যজনকভাবে গনেশ উল্টে যায়। বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল!
বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ) এর নিউজ টিম চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে ১৫১ শেখ মুজিব সড়কের সুলতান মার্কেটে নবাব এন্ড কোম্পানির অফিসের খোঁজ করতে যায়। কিন্তু সেখানে কোন অফিস নেই। এক সময় এখানে তিন তলায় ছিল নবাব এন্ড কোম্পানির অফিস। পরে জানা যায় একটু দুরে বাদাামতল প্রাইম ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার বিল্ডিং (বিএম স্কয়ার) নবাব এন্ড কোম্পানির খোঁজ পায় বিএনএ নিউজ টিম।
বিএম স্কায়ারে প্রবেশ পথে সেখানে থাকা অফিস সমূহের নাম ও অবস্থান লেখা থাকলেও নবাব এন্ড কোম্পানির নাম নেই। তিন তলায় গিয়ে দেখা গেল অফিসের প্রবেশ পথে কাচের দরজায় কম্পিউটার কম্পোজে লেখা রয়েছে ‘নবাব এন্ড কোম্পানি’।
ভিতরে প্রবেশ করতে দেখা গেল কয়েকজন বসে গল্প গুজব করছেন। এদের একজন জানতে চাইলেন পরিচয়। সংবাদকর্মী বলতেই আতংক দেখা গেল চেহারায়। নবাব খানকে কোথায় পাওয়া যাবে, তার বক্তব্য নিতে চাই বলতেই একজনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করতে পরার্মশ দিলেন। শুধু তিনিই জানাতে পারবেন কোম্পানির তথ্য! বললেন তিনি আগামীকাল অফিসে আসবেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য মোবাইল নম্বরও দিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে তিনি স্থানীয় একজন যুবলীগ নেতা!
পড়ুন আগের নিউজ : নবাব সাজলেন কর্মচারি, অত:পর কারাগারে
বিএনএনিউজ২৪, ওয়াই এইচ