মানিক ভাই ও মোস্তফা সরওয়ারকে ‘এ’ ক্লাস দেওয়া হয়েছে । মোমিন সাহেব, হাফেজ মুছা ও শাহাবুদ্দিন চৌধুরীকে ‘বি’ ক্লাস দেওয়া হয়েছে। শামসুল হক সাহেব, রাশেদ মোশাররফ ও ওবায়দুর রহমানকে এখনও সি ডিভিশনে রাখা হয়েছে, কারণ এরা নাকি ইনকাম ট্যাক্স দেয় না। ১৫০০ শত টাকার উপরে আয় হলে ‘বি’ ক্লাস দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি এমএ পাশ করলেও ‘সি’ ক্লাস হতে হবে। টাকা থাকলেই বড় ক্লাস, শিক্ষার দাম নাই । পদের দাম নাই, সম্মানের দাম নাই। এমনকি পদমর্যাদারও দাম নাই ।
আমি জেল কর্তৃপক্ষকে বললাম, যদি কোনো প্রফেসার, ডিসি, এসপি কোনোমতে ডিপিআর-এ গ্রেপ্তার হতে বাধ্য হয় তারও সি ক্লাস হবে এবং রোজ দেড় টাকায় খাওয়া ও নাস্তার সকল কিছু বন্দোবস্ত করতে হবে । রাস্তার কত পাগলকে ডিপিআর করেছে। শামসুল হক সাহেবের বাবার সম্পত্তি আছে, নিজে কাজকর্ম করেন না। জেলা, আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট । আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পলিটিক্যাল সেক্রেটারি ও এমপিএ ছিলেন, তাঁকেও যদি ক্লাস না দেওয়া হয় আর দেড় টাকার খাওয়াই যদি খেতে হয় তার বিচার তো এখন হতে পারে না, পরে দেখা যাবে। ওবায়দুর রহমান এমএ পাশ। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন, এখন আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক। তাকেও সি ক্লাস। রাশেদ মোশাররফের বাবা বড়লোক, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের সহ-সম্পাদক, বিরাট বাড়ি ঢাকা শহরে, নিজেও ছোটখাট ব্যবসা করে, তাকেও সি ক্লাস । কাকে দুঃখের কথা বলব? যে কোনো রাস্তার লোক টাকা উপার্জন করেছে দুর্নীতি করে, ইনকাম ট্যাক্স দেয় তাকে দিতে হবে ক্লাস ‘এ’। আমি তো ওদের সাথে দেখা করতে পারব না আর সান্ত্বনাও দিতে পারব না। এইবার সরকার আমাদের জবর খেলা দেখাচ্ছে । ইতরামির চরমে পৌঁছেছে।
এভাবে অত্যাচার চলতে থাকলে বাধ্য হব বোধ হয় এর প্রতিবাদ করতে। আমি বার বার জেল কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবাদ করেছি। বার বার বলতে
আমার লজ্জাও করে । জেল কর্তৃপক্ষ এক কথাই বলেন, ‘আমাদের কোনো হাত নাই । আমরা হুকুম তামিল করি।’ আমার মনে হয় আমাদের যে কষ্ট হতেছে তাতে তারা লজ্জিত হয়। কিন্তু কি করবে? ছোটলোক যেখানে শাসন চালায় তখন আর ভদ্রতা আশা করা কষ্টকর! আমি জানি উপরের কড়া হুকুম, আমার কাছে কেউই থাকতে পারবে না। কারও সাথে আলাপ করতে পারব না । একাকী রাখতে হবে। মনে মনে ভাবি আমি কষ্ট না পেলে আমাকে কষ্ট দেয় কে? যতই কষ্টের ভিতর আমাকে রাখুক না কেন, দুঃখ আমি পাব না । কারণ, ‘কোনো ব্যথাই আমাকে দুঃখ দিতে পারে না এবং কোনো আঘাতই আমাকে ব্যথা দিতে পারে না। এরা মনে করেছে বন্ধু শামসুল হককে জেলে দিয়ে যেমন পাগল করে ফেলেছিল, আজ আর তার কোনো খোঁজ নাই, কোথায় না খেয়ে বোধ হয় মরে গিয়েছে। আমাকেও একলা একলা জেলে রেখে পাগল করে দিতে পারবে। আমাকে যারা পাগল করতে চায় তাদের নিজেদেরই পাগল হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।
সূত্র: কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ১১৩-১১৪, লেখকঃ শেখ মুজিবুর রহমান, প্রকাশকালঃ ফাল্গুন ১৪২৩/ মার্চ ২০১৭
আরও পড়ুন :
গ্রন্থনা ও পরিকল্পনাঃ ইয়াসীন হীরা, সম্পাদনাঃ হাসিনা আখতার মুন্নী