26 C
আবহাওয়া
৭:০৮ পূর্বাহ্ণ - মে ৫, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » পুলিশের ঘাড়ে বন্দুক, ফায়ার করলো দুদকের আসামী!

পুলিশের ঘাড়ে বন্দুক, ফায়ার করলো দুদকের আসামী!

পুলিশের ঘাড়ে বন্দুক, ফায়ার করলো দুদকের আসামী!

।। বাবর মুনাফ/ এনামুল হক নাবিদ ।।

নাছির উদ্দিন। ১৯৮৬ সালের ২৩ আগস্টের আগে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল কোম্পানির অস্থায়ী সিকিউরিটি গার্ড ছিলেন। ১৯৯৬ সালের ২৩ আগস্ট একই প্রতিষ্ঠানে ২৩০ টাকা বেসিক বেতনে পিয়ন হিসাবে চাকুরি নেন। একই সঙ্গে যুক্ত হয় কর্মচারি ইউনিয়ন রেজিস্টেশন নম্বর ২০১৯ এ। ২০১০ সালে সংগঠনটি তাকে বহিস্কার করে। ২০১৩ সালে রেজিস্ট্রেশন নম্বর বি ২১১৬-তে যোগ দেন।

সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল খায়েরের আর্শিবাদে ২০১৪ সালের ‘ট্যাংক লরী হেলপার’ থেকে ‘চেকার’ পদে পদোন্নতি পান নাছির। ছয়মাসের মাথায় ফের ‘ক্লারিক্যাল সুপারভাইজার’ পদে পদোন্নতি পান। তখন থেকে টাকার খনির সন্ধান পান নাছির। পদ্মা অয়েল কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল খায়েরের আশ্রয়- প্রশ্রয়ে নাছির বড় শ্রমিক নেতা হয়ে ওঠেন এবং সিবিএ’র সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর তাকে আর পিছনে ফিরে থাকাতে হয়নি। পুরো পদ্মা অয়েল কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ তার হাতের মুঠোয় চলে আসে।

পুলিশের ঘাড়ে বন্দুক, ফায়ার করলো দুদকের আসামী!
মো. নাছির উদ্দিন

তার নির্দেশনা না মানলে কর্মক্ষেত্রে হয়রানি হতে হয়। এমনকী ১৪ শিকের কপাটে বন্দি থাকতে হয়। শুনে অবাক হয়েছেন? এটাই বাস্তব। ক্ষমতাধর নাছিরের রোষানলে পড়ে পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ল্যাবরেটরী সেকশনের টেস্টার মো. হারুন চৌধুরী নাশকতার মামলার আসামি হয়ে কারাগারে আটক রয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১৮ মে অনুষ্ঠিত সিবিএ নির্বাচনে ফের সাধারণ সম্পাদক হতে চেয়েছিলেন বাধ সাধেন তারই এলাকার পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ল্যাবরেটরী সেকশনের টেস্টার মো. হারুন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন নাছির বিরোধী একটি গ্রুপ। ফলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় সিবিএ’র সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হতে পারেননি। একদিকে সিবিএ সাধারণ সম্পাদক হতে না পারা অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে দুদকের মামলার জন্য হারুন চৌধুরীর ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন। সুযোগ খুঁজতে থাকেন মো. হারুন চৌধুরীকে শায়েস্তা করার।

গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর সেই মোক্ষম সময় পেয়ে যান কোটিপতি কেরানি নাছির। তার মালিকানাধীন আনোয়ারা চাতুরি এলাকায় শশী কমিউনিটি সেন্টারের সামনে পুলিশের সাথে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। নাছির এই খবর পেয়ে দ্রুত পদ্মা অয়েল কোম্পানির কর্মস্থল থেকে প্রথমে শশী কমিউনিটি সেন্টারে যায়। সেখান থেকে যায় আনোয়ারা থানায়।

নাছির থানায় পৌঁছানোর আগে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি কর্মীদের সংঘর্ষের এই ঘটনায় এসআই জয়নাল আবেদীন বাদি হয়ে নাশকতার অভিযোগে বিএনপি ১৬জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে। যা বিকাল ৪টা ৫ মিনিটে অনলাইনেই লিপিবদ্ধ করা হয়। থানায় বিলম্বে উপস্থিত হওয়ায় পুলিশের দায়ের করা ওই মামলায় পদ্মা অয়েল কোম্পানিতে কর্মরত তার প্রতিদ্বন্দ্বী ল্যাবরেটরী সেকশনের টেস্টার মো. হারুন চৌধুরীকে অভিযুক্ত করা সম্ভব হয়নি। তাতে কী? টাকায় কী না হয়?

পুলিশের ঘাড়ে বন্দুক, ফায়ার করলো দুদকের আসামী!
আনোয়ারা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সোহেল আহমেদ

আনোয়ারা থানার অফিসার ইনচার্জ সোহেল আহমেদ, ওসি (তদন্ত) মহিউদ্দিন আহমেদ মোটা অংকের লেনদেনের মাধ্যমে একই ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা ১৬ আসামি এবং নাছিরের বিরোধীতাকারী ৫ জনসহ ২১ জনকে আসামী করে নতুন করে মামলার সুযোগ করে দেয়। মামলার বাদি করা হয় নাছির উদ্দিনের মালিকানাধীন শশী কমিউনিটি সেন্টারের ম্যানেজার রাশেদ নেওয়াজ চৌধুরীকে। এই মামলায় ১১ নম্বর আসামি করা হয় আনোয়ারা থানার চৌমুহনীর উত্তর চাতরি গ্রামের প্রয়াত গোলাম কাদেরের সন্তান পদ্মা অয়েল কোম্পানির ল্যাবরেটরী সেকশনের টেস্টার মো. হারুন চৌধুরীকে। যা অনলাইনে পোস্টিং হয় রাত সাড়ে আটটায়।

মামলার এজাহার পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এজাহারে বাদি রাশেদ নেওয়াজ চৌধুরী যোগাযোগের জন্য যে নম্বরটি উল্লেখ করেছে তা শশী কমিউনিটি সেন্টারে সাইনবোর্ডেও শোভা পাচ্ছে! অথচ শশী কমিউনিটি সেন্টারে হামলা ভাঙচুর বা হামলার কথা উল্লেখ নেই মামলায়। একই ঘটনায় একই স্থানে একই সময়ে পুলিশ বাদি হয়ে মামলা করার পর নাছির উদ্দিনের মালিকানাধীন শশী কমিউনিটি সেন্টারের ম্যানেজার রাশেদ নেওয়াজ চৌধুরীকে দিয়ে কেন একটি নাশকতার মামলা নিলেন আনোয়ারা থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ? কেনইবা আসামীর তালিকায় পদ্মা অয়েল কোম্পানির ল্যাবরেটরী সেকশনের টেস্টার মো. হারুন চৌধুরীকে বিএনপির কর্মী বানিয়ে ১১ নম্বর আসামী করা হলো? কী যাদুতে আনোয়ারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেছে পদ্মার ‘ক্লারিক্যাল সুপারভাইজার’ ও শশী কমিউনিটি সেন্টারের মালিক নাছির উদ্দিন? জনমনে প্রশ্ন রয়েছে।

পুলিশের ঘাড়ে বন্দুক, ফায়ার করলো দুদকের আসামী!
পদ্মা অয়েল কোম্পানীর হাজিরা শীট

ঘটনার এখানে শেষ নয়, পদ্মা অয়েল কোম্পানির হাজিরা খাতা ও সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় ২০২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর ঘটনার দিন এবং পরের দিন ১৪ ডিসেম্বর হারুন চৌধুরী পদ্মা অয়েল কোম্পানীতে কর্মরত অবস্থায় ছিল। ১৮ ডিসেম্বর হারুন চৌধুরী পদ্মা অয়েল কোম্পানির এজিএমের কাছে ব্যবস্থাপকের (পরিচালনা) মাধ্যমে তিনি ১৩ ডিসেম্বর কর্মস্থলে ছিলেন এমন একটি প্রত্যায়ন পত্রের জন্য আবেদন করেন। মুহূর্তে এই খবর চলে যায় কেরানি নাছিরের কাছে। তিনি আচঁ করতে পারছিলেন ল্যাবরেটরী সেকশনের টেস্টার মো. হারুন চৌধুরী প্রত্যায়ন পত্র পেয়ে গেলে আদালত থেকে সহজে জামিন পেয়ে যাবেন। সে কারণে কোটিপতি কেরানি নাছির ফোন করে আনোয়ারা থানার এসআই ফারুককে ডেকে নেন পদ্মা অয়েল কোম্পানির পতেঙ্গা গুপ্তখালস্থ অফিসে। নিজের অতিথি পরিচয়ে এসআই ফারুকের মাইক্রোবাসকে পদ্মার প্রধান স্থাপনায় প্রবেশের ব্যবস্থা করেন নাছির। পরে সিকিউরিটি প্রধান শাহজাহান খানের সহযোগীতায় এসআই ফারুক হারুন চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। অথচ আদালতে পাঠানো ফরোয়াডিংয়ে কেইপিজেড এলাকা থেকে হারুন চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে উল্লেখ করে আনোয়ার থানা পুলিশ। তখন থেকে হারুন চৌধুরী চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রয়েছেন।

পুলিশের ঘাড়ে বন্দুক, ফায়ার করলো দুদকের আসামী!
দুদকের রেকর্ডপত্রের আবেদন

অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার চাতরী গ্রামের মৃত শেখ মোহাম্মদের ছেলে নাছির উদ্দিন চট্টগ্রাম শিশু একাডেমি সংলগ্ন অভিজাত ‘ইক্যুইটি’ ভবনে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। কোটিপতি কেরানি খ্যাত নাছির পদ্মা অয়েল কোম্পানির টার্মিনালের শীর্ষ কর্তাদের যোগসাজসে সিস্টেম লজ ও তাপমাত্রায় বৃদ্ধিজনিত তেল পাচার করে গড়ে তুলেন নামে-বেনামে অবৈধ সম্পদের পাহাড়। বদলে যায় তার বেশভূষা। পরিবারের জন্য কিনেছেন, নতুন মডেলের দামি গাড়ি। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি হয়ে পদ্মা অয়েল কোম্পানির অফিসারের জন্য বরাদ্দ চট্টমেট্টো চ ১১-৭২৫৩ মাইক্রোবাসটি ব্যবহার করে আসছেন বছরের পর বছর।

২০২৩ সালের ১১ ডিসেম্বর নাছিরের দুর্নীতি অনিয়মের তথ্য-প্রমাণসহ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন পদ্মার এক কর্মচারি। অভিযোগে বলা হয়, কর্মস্থলে উপস্থিত না হয়ে সপ্তাহে একদিন এসে স্বাক্ষর করেন। পুরো মাসের বেতন ভাতার পাশাপাশি ওভারটাইম পেমেন্ট নেন ক্ষমতাধর নাছির। ২০১৪ সাল থেকে পদ্মায় নাছিরের হরিলুট চলছে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাক, এই ব্যাপারে টু শব্দ করাও সাহস পায়নি পদ্মা ব্যবস্থাপনার পরিচালকসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা।

পুলিশের ঘাড়ে বন্দুক, ফায়ার করলো দুদকের আসামী!
আনোয়ারা থানার এসআই ফারুক

অভিযোগ আছে, আইএম মোস্তাক আহম্মেদ, ইআরসি আমিনুল হক, সিকিউরিটি অফিসার মোহাম্মদ শাহজাহান খান অদৃশ্য ক্ষমতার অধিকারি নাছিরের কথায় উঠ-বস করেন। তাদের ছায়ায় চতুর্থ শ্রেণির এই কর্মচারি পদ্মা অয়েল কোম্পানির বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে।

পুলিশের ঘাড়ে বন্দুক, ফায়ার করলো দুদকের আসামী!
মামলার এজাহার

দুদকের নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পদ্মা অয়েল কোম্পানি দাপুটে কেরানি নাছির উদ্দিন ২ কোটি ১১ লাখ ৭১ হাজার ১৩০ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপন করেন। ২০২৩ সালের ২ নভেম্বর নাছির উদ্দিনের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ মামলা করেন কার্যালয়টির উপ-সহকারী পরিচালক মো. সবুজ হোসেন। এক সপ্তাহ পর হাইকোর্ট থেকে এক মাসের অন্তবর্তকালীন জামিন নেয় নাছির উদ্দিন। গত ৯ জানুয়ারি নাছিরকে দেয়া হাইকোর্টের জামিনের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ওইদিনই চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা ও স্পেশাল জজ ড. বেগম জেবুননেছার আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চায় পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন। কিন্তু আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয়।

সরকারি চাকুরি বিধি-১৭ অনুযায়ি সরকারি কর্মচারী সরকারের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে ব্যক্তিগত ব্যবসা বা অন্য কোন চাকরি বা কার্য গ্রহণ করতে পারবেন না। পদ্মা অয়েল কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা নাছিরের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয়টি জানার পরও চুপ রয়েছেন।

এছাড়া ফৌজদারী অভিযোগে অথবা দেনার দায়ে জেলে আটক সরকারি কর্মচারী গ্রেপ্তার হওয়ার তারিখ হতে সাময়িক বরখাস্ত হিসাবে বিবেচিত হবেন। তেল চুরির টাকার ভাগবাটোয়ারা শীর্ষ কর্মকর্তরা পায় বলেই দুর্নীতি মামলায় চট্টগ্রাম কারাগারে আটক নাছিরের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ দূরে থাক, উল্টো তাকে কারাগার থেকে মুক্ত করার জন্য চেষ্টা তদবির করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিএনএনিউজ টুয়েন্টি ফোর

Loading


শিরোনাম বিএনএ