বিএনএ, ডেস্ক: শুরু হয়েছে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজান। এই মাসের প্রধান দুটি আমল হলো সিয়াম ও কিয়াম। সিয়াম বা রোজা হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, দাম্পত্য মিলন ও রোজা ভঙ্গ হওয়ার সব বিষয় থেকে দূরে থাকা। আর কিয়াম হলো রাতে তারাবির নামাজ।
সোমবার (১১ মার্চ) সন্ধ্যায় হিজরি ১৪৪৫ সনের রমজান মাস শুরু হয়েছে। সে অনুযায়ী মঙ্গলবার (১২ মার্চ) থেকে রমজান মাস গণনা শুরু হবে ও মুসলমানরা রোজা রাখা শুরু করেছেন। সেক্ষেত্রে গত সোমবার রাতেই এশার নামাজের পর তারাবির নামাজ পড়া শুরু হয়েছে। এ উপলক্ষে মসজিদে মসজিদে তারাবি নামাজ আদায়ে করেছেন বিভিন্ন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা।
রমজানের সিয়ামের বিশেষ অনুষঙ্গ তারাবির সালাত। রমজান মাসে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের বাড়তি নেয়ামত হলো নামাজে তারাবি। পবিত্র রমজান মাসে সারা দিন রোজা রেখে রাতে তারাবির নামাজ পড়া অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ ইবাদত, যা আল্লাহর কাছে অতি পছন্দনীয়।
তারাবি মানে কি?
তারাবি শব্দটি একটি আরবি পরিভাষা। এর আভিধানিক অর্থ হলো আরাম করা, বিশ্রাম করা, ধীরে ধীরে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা ইত্যাদি। তারাবির নামাজের ফাঁকে ফাঁকে যেহেতু কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নেওয়া হয় এবং নামাজের সময় প্রলম্বিত করে ইবাদতের মাত্রা বৃদ্ধি করা হয়, এ জন্য একে তারাবির নামাজ বলা হয়ে থাকে।
পবিত্র মাহে রমজানের বিশেষ ইবাদত হলো তারাবির নামাজ। এই নামাজ প্রতিদিন এশার ফরজ ও সুন্নত নামাজের পর এবং বিতরের আগে আদায় করা হয়।
২০ রাকাত তারাবির নামাজ আদায় করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ, গুরুত্বের দিক থেকে ওয়াজিবের কাছাকাছি। ওজর বা অপারগতা ছাড়া তারাবির নামাজ পরিত্যাগ করা বড় গুনাহ।
পবিত্র কুরআন নাজিলের মাসে নামাজের মাধ্যমে কুরআন খতম অশেষ সওয়াবের। এটা জামাত সহকারে আদায় করতে পারলে অপরিসীম ফজিলত রয়েছে।
আমাদের দেশে দুই ধরনের তারাবি প্রচলিত। একটি হলো সুরা তারাবি এবং অন্যটি হলো খতম তারাবি। সুরা তারাবি হলো পবিত্র কুরআনের যে কোনো সুরা দিয়ে ২০ রাকাত নামাজ আদায় করা।
খতম তারাবি হলো রমজান মাসে সম্পূর্ণ কুরআন সহকারে তারাবি আদায় করা। উভয় পদ্ধতিই ইসলাম অনুমোদন করে। তবে খতমে তারাবিতে সওয়াব বেশি। সুরা তারাবির মাধ্যমে নামাজ আদায় করলেও নামাজ আদায় হবে।
তারাবি কীভাবে পড়বেন
তারাবি নামাজ দুই দুই রাকাত করে পড়তে হয়। দুই রাকাত নামাজ আদায় করে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করা। এভাবে চার রাকাত আদায় করার পর একটু বিশ্রাম নেওয়া। তাসবিহ-তাহলিল পড়া বা কিছু সময় বিরতি নেওয়া উত্তম। বিশ্রামের সময় তাসবিহ-তাহলিল পড়া, দোয়া-দরুদ ও জিকির-আজকার করা। এরপর আবার দুই দুই রাকাত করে আলাদা আলাদা নিয়তে তারাবি আদায় করা।
তারাবি নামাজের দোয়া
বাংলা উচ্চারণ: ‘সুবহানা জিল মুলকি ওয়াল মালাকুতি, সুবহানা জিল ইয্যাতি ওয়াল আঝমাতি ওয়াল হায়বাতি ওয়াল কুদরাতি ওয়াল কিব্রিয়ায়ি ওয়াল ঝাবারুতি। সুবহানাল মালিকিল হাইয়্যিল্লাজি লা ইয়ানামু ওয়া লা ইয়ামুত আবাদান আবাদ; সুব্বুহুন কুদ্দুসুন রাব্বুনা ওয়া রাব্বুল মালায়িকাতি ওয়ার রূহ।’
চার রাকাত তারাবি আদায় করে বিশ্রাম বা বিরতির পর ব্যাপক প্রচলিত একটি দোয়া রয়েছে। যা দেশের প্রায় মসজিদে পড়া হয়।
উল্লেখ্য, তারাবি নামাজের ৪ রাকাত পর পর পড়ার এ দোয়াটি ব্যাপক প্রচলিত। তবে এ দোয়ার সঙ্গে তারাবি নামাজ হওয়া কিংবা না হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
এমন নয়, এ দোয়া না জানলে বা তারাবি নামাজে না পড়লে নামাজ হবে না। বরং যে কোনো দোয়াই পড়া যাবে। তবে এ সময়টিতে কোরআন-সুন্নাহর দোয়া, তাওবাহ-ইসতেগফারগুলো পড়াই উত্তম।
তারাবি নামাজে মোনাজাত
বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকাল জান্নাতা ওয়া নাউজুবিকা মিনাননার। ইয়া খালিক্বাল জান্নাতি ওয়ান নার। বিরাহমাতিকা ইয়া আঝিঝু ইয়া গাফফার, ইয়া কারিমু ইয়া সাত্তার, ইয়া রাহিমু ইয়া ঝাব্বার, ইয়া খালিকু ইয়া বার্রু। আল্লাহুম্মা আঝিরনা মিনান নার। ইয়া মুঝিরু, ইয়া মুঝিরু, ইয়া মুঝির। বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমিন।’
অনেকেই চার রাকাত পর পর মোনাজাত করে থাকেন। আবার অনেকে পুরো নামাজ শেষ করে মোনাজাত একসঙ্গে মোনাজাত দেন। তবে নামাজ শেষ করে বিতর পড়ে মোনাজাত দেওয়াই উত্তম। মোনাজাতের জন্যও দেশব্যাপী মানুষের কাছে একটি দোয়া প্রাচীনকাল থেকেই ব্যাপকভাবে পড়া হয়।
তারাবি নামাজের দোয়ার মতো এ মোনাজাতটিও নামাজ হওয়া বা না হওয়ার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। তবে মোনাজাতের শব্দগুলো অনেক চমৎকার ও প্রাঞ্জল। অনেকে তারাবি নামাজের মোনাজাতের জন্য এ দোয়াটিকে আবশ্যক মনে করেন। কেউ কেউ এমনও মনে করে, এ দোয়াটি ছাড়া তারাবি নামাজের মোনাজাত হবে না। এ ধারণা/বিশ্বাস মোটেও ঠিক নয়। তবে এ দোয়ায় মোনাজাত দিলে গোনাহ হবে তাও নয়।
রমজানে বিশেষ দোয়া
রমজানজুড়ে বিশ্ব নবীর এ ইসতেগফার দুটি বেশি বেশি পড়া জরুরি। আর তাহলো-
১। বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুওউন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফা’ফু আ’ন্নি।
২। বাংলা উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা আনতা রাব্বি লা ইলাহা ইল্লা আনতা খালাক্বতানি; ওয়া আনা আ’বদুকা ওয়া আনা আ’লা আ’হদিকা ওয়া ওয়া’দিকা মাসতাত্বা’তু, আউজুবিকা মিন শাররি মা সানা’তু আবুউলাকা বিনি’মাতিকা আলাইয়া; ওয়া আবুউ বিজামবি ফাগফিরলি ফা ইন্নাহু লা ইয়াগফিরুজ জুনুবা ইল্লা আনতা।’
আল্লাহতাআলা মুসলিম উম্মাহকে যথাযথভাবে তারাবি নামাজ আদায় করার তাওফিক দান করুন। রাতের নামাজ (তারাবি) আদায়ের মাধ্যমে বিগত জীবনের সব গুনাহ থেকে মুক্ত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
তারাবি নামাজের ফজিলত
তারাবি নামাজে যেহেতু প্রতি চার রাকাত পর পর একটু বিশ্রাম নিয়ে তাসবিহ ও দোয়া পাঠ করা হয়, তাই এই নামাজকে সালাতুত তারাবিহ বা তারাবি নামাজ বলা হয়।
তারাবির নামাজ এশার ফরজ ও সুন্নত নামাজের পর এবং বিতিরের পূর্বে আদায় করা হয়। তারাবির নামাজ সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। যেটা গুরুত্বের দিক থেকে ওয়াজিবের কাছাকাছি।
তারাবির ফজিলত সম্পর্কে হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে নেকির আশায় কিয়ামুল লাইল তথা তারাবি আদায় করবে, তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ ক্ষমা করা হবে। (বুখারি ও মুসলিম)।
রাসুল সা. তারাবিকে কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছেন এবং তারাবি যেন ফরজ না হয়ে যায়, যেটা আদায়ে উম্মতের কষ্ট হতে পারে, সেটা রাসূল সা. এর একটি হাদিসে থেকেই বোঝা যায়।
হযরত আয়েশা রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. একবার রমজান মাসে রাত্রিবেলায় মসজিদে নববীতে নামাজ (তারাবি) আদায় করলেন। উপস্থিত লোকজনও তার সঙ্গে নামাজ আদায় করলেন। একইভাবে তারা দ্বিতীয় দিনেও নামাজ আদায় করলেন এবং লোকসংখ্যা অনেক বেশি হলো।
অতঃপর তৃতীয় এবং চতুর্থ দিনেও মানুষ একত্রিত হলো। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সা. হুজরা থেকে বেরিয়ে তাদের কাছে এলেন না। অতঃপর সকাল হলে তিনি এলেন এবং বললেন, তোমাদের অপেক্ষা করার বিষয়টি আমি লক্ষ্য করেছি। কিন্তু শুধু এ ভয়ে আমি তোমাদের কাছে আসা থেকে বিরত থেকেছি, আমার আশঙ্কা হচ্ছিল, না জানি তোমাদের ওপর তা (তারাবি) ফরজ করে দেওয়া হয়। (বুখারি)
তারাবি বিশ রাকাত সুন্নাত। এটা রাসুল সা., সাহাবি, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন এবং মুজতাহিদ ইমামগণের আমল দ্বারা প্রমাণিত।
হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. রমজান মাসে ২০ রাকাত এবং বেতের পড়তেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা)
সমস্ত সাহাবিদের আমলও ২০ রাকাত ছিল। রাসুল সা.-এর নাতি হজরত আলি ইবনে হাসান রা. থেকে বর্ণিত, হজরত ওমর রা.-এর নির্দেশে লোকদেরকে নিয়ে উবাই বিন কাব রা. ২০ রাকাত তারাবি পড়েছেন। (আবু দাউদ)
এভাবে খলিফা ওমর, ওসমান, আলী রা.-সহ সব সাহাবিদের ঐকমত্যে ২০ তারাবি পড়া হয়েছে।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, মক্কা ও মদিনা শরিফে সাহাবায়ে কেরামের যুগ হতে আজ পর্যন্ত সব সময় ২০ রাকাত তারাবি খতমে কোরআনসহ জামাতের সঙ্গে পড়া হয়। তারাবি নামাজে পূর্ণ কোরআন তেলাওয়াত বা শ্রবণ করা ও সুন্নত। রাসুল সা. বলেন, যে ব্যক্তি কোরআনের একটি হরফ পাঠ করবে সে একটি নেকি অর্জন করবে এবং একটি নেকিকে ১০ গুণ বৃদ্ধি করে প্রদান করা হবে। (তিরমিজি)
কোরআনে কারিম তেলাওয়াতের মতো শুনলেও একই রকম সওয়াব। এজন্য তারাবি নামাজে পরিপূর্ণ আদবের সঙ্গে মনোযোগ দিয়ে কোরআন শুনতে হবে।
২০ রাকাত না পড়ে ইমামকে রেখে মসজিদ ত্যাগ করা উচিত নয়। রাসুল সা. বলেন, যে ব্যক্তি ইমামের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত কিয়ামুল লাইল তথা তারাবি আদায় করবে, তার জন্য পুরো রাত সিয়াম পালনের সওয়াব লাভ হবে। (তিরমিজি)
মাহে রমজানের বিশেষ ফজিলত পূর্ণ আমল তারাবির নামাজে কোনোভাবেই অবহেলা করা উচিত নয়। আসুন আমরা যথাযথ গুরুত্বের সাথে তারাবির নামাজ আদায় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদেরকে তৌফিক দান করুন।
বিএনএনিউজ/ বিএম/এইচমুন্নী