বিএনএ, চট্টগ্রাম: ১১ জুলাই। মিরসরাই ট্রাজেডি দিবস। দেখতে দেখতে পার হলো বারোটি বছর। স্বজনের বুকফাটা আহজারীতে এখনো ভারি হয় আবুতোরাবের আকাশ বাতাস। চোখের জল শুকিয়ে শোকে পাথর। এখনো গভীর রাতে ভেসে আসে কান্নার রোল। স্মৃতি বলতে শুধুই ছবির ফ্রেম। নাড়ী ছেঁড়া ধন ছেলেকে হারিয়ে মা-বাবা সেই ছবি বুকে আকড়ে ধরে আহজারী করেন। কখনো কখনো হয়ে যান নির্বাক।
২০১১ সালের ১১ জুলাই মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া-আবু তোরাব সড়কে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় স্কুলছাত্রসহ ৪৫ জন। শোকাহত পরিবারগুলোকে সান্তনা দিতে ছুটে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। খালেদা জিয়া, সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দৌজা চৌধুরী, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনসহ বিদেশি প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।
এ ১২ বছরকে ১২ দিনের চেয়েও কম মনে হয় সন্তান হারানো মা কোহিনুর বেগমের। তিনি ট্রাজেডিতে নিহত রায়হান উদ্দিনের মা। তিনি বলেন, ‘আমার এখনো বিশ্বাস হয় না আমার ছেলে নেই। এইতো সেদিন রায়হান খেলা দেখতে বের হয়েছিল, সে ফিরে আসবে।’
মায়ের চাপা কান্নাকে উস্কে দিতে বছর ঘুরে আবারো বেদনা হয়ে ফিরেছে ১১ জুলাই। ১২ বছর আগের ১১ জুলাইয়ের কথা মনে পড়তেই কান্নায় ভেঙে পড়েন সন্তান হারানো মায়েরা। এ কান্নার শেষ কোথায় জানে না কেউই। সারা বছর হারানো ছেলেকে ভুলে থাকতে পারলেও নিষ্পাপ কোমলমতি সন্তানদের এ দিনে ভুলে থাকতে পারেন না কোনো মা।
তার সন্তান মারা যাওয়ার ১২ বছর পার হয়েছে শুনতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তিনি জানান, ২০১১ সালে তার ছেলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়তো। সে হিসেবে এতদিনে তার ছেলের ডিগ্রি পাস করার কথা ছিল।
কথা হয় জুলাই ট্রাজেডি থেকে বেঁচে ফেরা তৎকালীন নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সোহরাব হোসেনের সাথে। সোহরাব বলেন, ‘আমরা খেলায় জেতার খুশিতে এতটাই বিমোহিত ছিলাম যে কখন আমরা রাস্তার পাশে খাদের পানিতে পড়ে ট্রাক চাপা পড়েছি কিছুই বলতে পারব না। শুধু দেখছিলাম চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম আমি হয়তো মারা যাচ্ছি। বের হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে হাত পা ছুঁড়তে থাকি। আমার মতো অন্যরাও চেষ্টা করেছে। একটা সময় আমি বের হতে পারি। অন্যরা পানির ভেতর থেকে টানাটানি করে আমার হাত পা নখ দিয়ে কেটে ফেলেছিল।’
তিনি আরো বলেন, ‘যখন আমি পানি থেকে উঠে উপরে আসি, তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না আমি বেঁচে আছি। আমার হাত পা নিথর হয়ে যায়। সে মুহূর্তের পর আর কিছুই আমার মনে নেই। আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এরপরই আমি অসুস্থ হয়ে যাই। বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থাকার পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরি। আমি বেঁচে ফিরেছি, অন্যরা মারা গেছে এটা মনে হতেই আমার খুব কষ্ট হয়।’
নিহত ছাত্রদের স্মরণে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রবেশমুখে স্থাপন করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’। যার নির্মাতা নিজাম মেস্ত্রি। তার ছেলেও নিহত হয় মিরসরাই ট্রাজেডিতে। বুকের কষ্ট বুকে চেপে পরম ভালোবাসায় নির্মাণ করেছেন স্মৃতিস্তম্ভ আবেগ। নির্মাণের পর আবেগে সাঁটানো নিহত ছেলের ছবিতে হাত বুলিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন নিজাম মেস্ত্রি। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে মারা যায়নি। সে হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকবে মানুষের আবেগ হয়ে।’
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ১১ জুলাই মিরসরাই স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবলের ফাইনাল জিতে মিনি ট্রাকে ফিরছিল সবাই। বড়তাকিয়া-আবুতোরাব সড়কের সৈদালী এলাকায় ট্রাকটি উল্টে ছিটকে পড়ে ডোবায়। ঘটনার পরপর ডোবার পানি থেকে উদ্ধার হয় লাশ আর লাশ। অন্যদিকে ছেলের মৃত্যুর খবরে হৃদক্রিয়া বন্ধে মারা যান হরনাথ। সব মিলিয়ে ৪৫ জনের প্রাণের বিনিময়ে রচিত হয় মিরসরাই ট্র্যাজেডি।
আবু তোরাব বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩৪ জন শিক্ষার্থী প্রাণ হারায় এই দুর্ঘটনায়। এছাড়া আবু তোরাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিনজন, প্রফেসর কামাল উদ্দিন চৌধুরী কলেজের দুজন, আবু তোরাব ফাজিল মাদরাসার দুজন এবং আবু তোরাব এস এম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষার্থী মারা যায়।
এ রকম একসঙ্গে এতোজন সতীর্থ হারানো দিন বাংলাদেশ দেখেনি, ওদের বন্ধুরা হতবিহম্বল হয়ে পড়ে। অনেকে বারবার মুর্ছা যান। এখনো তাদের মনের দাগ শুকায়নি। আজও সতীর্থদের মৃত্যুতে শোকাহত আবু তোরাবের জনপথ।
বিএনএ/এমএফ