গণভোট বা জনমত জরিপ (Referendum) শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন referre থেকে, যার অর্থ ‘ফিরিয়ে দেওয়া’ বা ‘উত্তর পাওয়া’। গণভোট বা প্রত্যক্ষ ভোটের ধারণাটি প্রাচীন গ্রীস এবং রোমের সময় থেকেই বিভিন্ন রূপে বিদ্যমান ছিল। তবে গণভোট শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয় সুইজারল্যান্ডের গ্রাউবুন্ডেন ক্যান্টনে ষোড়শ শতাব্দীতে।
এ কথায় গণভোট বা জনমত জরিপ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে জনগণ সরাসরি অংশগ্রহণ করে ব্যালটে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ ভোটের মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে মতামত দেয়।

আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় উত্তর আমেরিকা ম্যাসাচুসেটস বে কলোনিতে ১৬৪০ সালে প্রথম গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। সুইজারল্যান্ডের আধুনিক সংবিধানে বাধ্যতামূলক গণভোটের বিধান ১৮৪৮ সালে প্রবর্তন করা হয়, যেখানে যেকোনো সাংবিধানিক পরিবর্তন জনগণের ভোটে অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। ১৯৭০ দশক থেকে গণভোট সারা বিশ্বে বেশ সাড়া ফেলে এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে মোট তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে দুটি ছিল প্রশাসনিক এবং একটি সাংবিধানিক গণভোট। আসুন জেনে নেই, বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত তিনটি গণভোটের আদ্যোপান্ত।
বাংলাদেশে প্রথম গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৭ সালের ৩০শে মে, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনকাজের বৈধতা যাচাইয়ের জন্য। এতে প্রশ্ন রাখা হয় রাষ্ট্রপতি এবং তার নীতি ও কর্মসূচির প্রতি তারা আস্থা রাখেন কি না? তখন দেশের মোট ভোটার ছিলেন ৩ কোটি ৮৪ লাখ। দেশের ২১ হাজার ৬৮৫টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
ফলাফলে দেখা যায়, ৮৮ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পড়ে। এর মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছিল ৯৮ দশমিক ৯ শতাংশ, ‘না’ ভোট ছিল মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ।
দ্বিতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের নীতি ও কর্মসূচির বৈধতা যাচাইয়ের জন্য ছিল এই গণভোট। আস্থা থাকলে জেনারেল এরশাদের ছবিসহ ‘হ্যাঁ’ বাক্সে এবং আস্থা না থাকলে ‘না’ বাক্সে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, ভোটার অংশগ্রহণের হার ছিল ৭২ দশমিক ২ শতাংশ। এর মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছিল ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ‘না’ ভোট ছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ই ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। এরপর পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয় বিএনপি। ১৬ বছরের রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসন থেকে প্রধানমন্ত্রীশাসিত সংসদীয় পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৯১ সালের ৬ই আগস্ট সংসদে বিল পাস হয়। সংবিধানে দ্বাদশ সংশোধনীর ওই বিলে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দেবেন কি না, তা নির্ধারণে ওই বছরের ১৫ই সেপ্টেম্বর গণভোট অনুষ্ঠিত হয়।
ভোটে অংশগ্রহণের হার ছিল ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ, যেখানে ৮৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোটার ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়ে সংসদীয় প্রজাতন্ত্রকে সমর্থন করেন। অন্যদিকে ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ ভোটার ‘না’ ভোট দেন।
২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেয় নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মাদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বিষয়ে সংস্কার আনতে গঠন করা হয় ঐক্যমত কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকে জুলাই সনদের ভিত্তিতে সংবিধান সংস্কারের বৈধতা নিশ্চিত করতে গণভোটের প্রস্তাব দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে কমিশনের পক্ষ থেকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ বাস্তবায়নের সুপারিশমালা হস্তান্তর করা হয়।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫-এর খসড়ায় বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত সংবিধান সংস্কার বিষয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। গণভোটের ব্যালটে প্রশ্ন থাকবে—আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং এর তফসিল-১ এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন? এই প্রশ্নের উত্তরে ব্যালট পেপারে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে নির্ধারিত বাক্সে প্রদান করতে হবে।
প্রসঙ্গত, গত ১৭ই অক্টোবর স্বাক্ষরিত জুলাই সনদে এসব সংশোধনী বিষয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমত সংযোজিত থাকলেও চূড়ান্ত তফসিলে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে এই নিয়ে জোর আপত্তি তুলেছে বিএনপি।
কমিশন জানিয়েছে, বাস্তবায়ন আদেশ অনুযায়ী অনুষ্ঠিত গণভোটে যদি ইতিবাচক সম্মতি পাওয়া যায়, তাহলে সংবিধান সংস্কার বিলটি সংবিধান সংস্কার পরিষদকে তার দায়িত্ব পালনে সহায়ক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
তবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ থেকে ২৭০ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে যদি সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে গণভোটে অনুমোদিত সংবিধান সংস্কার বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে।
ঐকমত্য কমিশন প্রণীত আদেশে গণভোট কীভাবে হবে এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদের গঠন ও কার্যাবলি তুলে ধরা হয়েছে। খসড়া আদেশে বলা হয়েছে, ‘এই আদেশ জারির অব্যবহিত পর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে যথোপযুক্ত সময়ে অথবা উক্ত নির্বাচনের দিন এই আদেশ অনুসারে গণভোট অনুষ্ঠান করা হইবে।’
জামায়াত ইসলামী, এনসিপি এবং জামায়াত ইসলামী ঘরনার ৮টি দল এই নভেম্বরেই গণভোট দাবি করেছে। অপরদিকে বিএনপি এই দাবির বিরোধীতা করে বলেছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন পৃথক ব্যালটে গণভোটের প্রস্তাব করেছে। দলটি জানিয়ে দিয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কোন অবস্থায় গণভোট মেনে নিবে না।
এই অবস্থায় অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার,জামায়াত ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি এই প্লাটফরমে অবস্থান নিলেও বিএনপি বিপরীত অবস্থানে রয়েছে। ফলে গণভোট কখন অনুষ্ঠিত হবে, আদৌ হবে কীনা তা নিয়ে সংশয়-সন্দেহ রয়েছে।
সৈয়দ সাকিব
![]()
