গত ৫ আগষ্ট ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের শরিক সমমনা দলগুলোর ঐক্য সুদৃঢ় রাখার উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে আসনভিত্তিক জোট নেতাদের সহযোগিতা করতে স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীকে নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে দলটি। ওই চিঠিতে মিত্র পাঁচটি দলের ৬ শীর্ষ নেতাকে জনসংযোগ এবং তার দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমে সহায়তা করতে নির্বাচনি আসনের থানা, উপজেলা, পৌরসভার বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে দলটির দপ্তর থেকে ওইসব আসনের স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীকে চিঠি দিয়েছে। যার অনুলিপি জোটনেতাদের দেওয়া হয়েছে।
যারা আগামী নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসাবে সবুজ সংকেত পেয়েছেন তাদের মধ্যে, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রবকে লক্ষ্মীপুর-৪ আসন, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাকে বগুড়া-২, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকিকে ঢাকা-১২, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরকে পটুয়াখালী-৩, গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খানকে ঝিনাইদহ-২ এবং জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদাকে কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি চিঠিতে ওইসব সংসদীয় আসনের থানা-উপজেলা ও পৌরসভা বিএনপির নেতাকর্মীকে জোটনেতাদের সহায়তা করতে বলা হয়েছে। এসব চিঠির বাহিরে ১২ দলীয় জোট নেতা ও বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিমকে মৌখিকভাবে লক্ষ্মীপুর-১ আসনে কাজ করতে বলা হয়েছে। ওই এলাকার বিএনপি নেতাকর্মীকে এ বিষয়ে মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ সব চিঠির মাধ্যমে তারা যাতে প্রতিবন্ধকতা ছাড়া কাজ করতে পারেন, সেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে নিজ নিজ এলাকায় জনসংযোগের মতো কর্মসূচি, কর্মিসভা, সাংগঠনিক সভা যাতে নির্বিঘ্নে করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কারণ হিসাবে তারা বলেন, ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন স্থানে ওই নেতারা কাজ করতে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। এমনকি মামলা পর্যন্ত দেওয়ার ঘটনাও রয়েছে। এছাড়া নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনাও আছে। এসব বিষয়ে বিএনপির হাইকমান্ডকে অবহিত করলে, তারা বিএনপির নেতাকর্মীকে এ চিঠি দিয়ে সহায়তা করতে নির্দেশনা দিয়েছে। যাতে কোনো রকম বাধা না দেওয়া হয়। কিন্ত যে সব আসনে চিঠি পাঠানো হয়েছে সেসব এলাকার বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
বিএনপি সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মাঠে ছিলেন এমন দলের নেতাদেরও বিএনপি জোটে নিতে চায়। দিতে চায় দলীয় প্রতীক ধানের শীষ। আগামী সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর সরকার গঠন নিশ্চিতের পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিরোধীতাকারিদের সংখ্যা কমাতে চায় বিএনপি।
গত বছরের ১৩ জুলাই ‘রাষ্ট্র মেরামতে’ ৩১ দফা ঘোষণা করে বিএনপি। সে সময়ে বিএনপির পক্ষ থেকে আন্দোলনকারী দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু মিত্রদলগুলো খুব আমলে নেয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপি জাতীয় সরকারের বিষয়টি আবার সামনে এনেছে। সম্প্রতি বিএনপির ঢাকা বিভাগের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে তারেক রহমান অনলাইনে যুক্ত হয়ে বলেন, জনগণের সমর্থন নিয়ে বিএনপি ভবিষ্যতে ‘জাতীয় সরকারের’ মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করতে চায়।
তাঁর দাবি, ‘স্বাধীনতার পর একটি জাতীয় সরকারের পরিবর্তে আওয়ামী লীগের দলীয় সরকার ক্ষমতায় আসায় দেশ প্রথম দিন থেকেই বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে একটি বিরাট অংশ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেশ গঠনে কোনো অবদান রাখতে পারেনি।’
জাতীয় সরকারে কারা থাকবেন, তার ইঙ্গিত দিয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘জনগণ নিশ্চয়ই সেসব দল বা ব্যক্তিকে জাতীয় সরকারে শামিল দেখতে চাইবেন না।’ এর মাধ্যমে তারেক রহমান সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে ইঙ্গিত করেছেন। অর্থাৎ বিএনপি বা তারেক রহমান প্রস্তাবিত জাতীয় সরকারে আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগীরা থাকছে না। কিন্তু এর বাহিরে বাম–ডান–মধ্যপন্থী যেসব দল আছে, তাদের সবাই থাকছে। বিএনপির এই জাতীয় সরকারে থাকছে জামায়েত ইসলামী, এটা এক প্রকার নিশ্চিত।
বাংলাদেশে জাতীয় সরকারের প্রস্তাব নতুন নয়। স্বাধীনতার পর ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদই প্রথম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব দলকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলেছিলেন। আওয়ামী লীগ পাত্তা দেয়নি।
পঁচাত্তরে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জাসদ নেতা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আবু তাহের আওয়ামী–বাকশালী বাদে সব দলকে নিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তা বাস্তবায়িত হয়নি।
সম্প্রতি বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে শরিক ছিলেন এমন রাজনৈতিক দলের নেতাদের স্ব-স্ব এলাকায় জনসংযোগ ও সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানোর সহযোগীতা করার নির্দেশনা চিঠি রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে। এর মধ্য দিয়ে বিএনপি জাতীয় সরকার গঠনের দিকে হাঁটছে, এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিএনএ/ শামীমা চৌধুরী শাম্মী, ওজি/এইচমুন্নী