বিএনএ, চট্টগ্রাম: //মনির ফয়সাল//
সারাদেশে উন্নয়নে মহাযজ্ঞ চলছে। তারই টেউ লেগেছে চট্টগ্রামে। দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে চট্টগ্রাম। কর্ণফুলী টানেলের পর চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় বিনিয়েগে নির্মাণ হচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এর তত্ত্বাবধানে ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের নির্মাণকাজ চলছে পুরোদমে। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পের পাইলিং কাজ উদ্বোধন করা হয়। ইতোমধ্যে প্রকল্পের প্রায় ৫০ শতাংশ নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম নগরীর যানজট নিরসনে ২০১৭ সালের ১১ জুলাই ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়। অনুমোদনের দেড় বছর পর ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পটির পিলার পাইলিং কাজের উদ্বোধন করেন। তখন ২০২০ সালের মধ্যেই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সাড়ে তিন কিলোমিটার অংশের অ্যালাইনমেন্ট নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে জটিলতা তৈরি হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। পরে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
৯টি জংশনে ২৪টি র্যাম্প(গাড়ি ওঠানামার পথ)
এ প্রকল্পের অধীনে ৯টি জংশনে ২৪টি র্যাম্প (গাড়ি ওঠানামার পথ) নির্মাণের কথা রয়েছে। এর মধ্যে নগরীর লালখানবাজার থেকে শুরু হওয়া প্রায় সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এক্সপ্রেসওয়েতে টাইগারপাসে ৪টি, আগ্রাবাদে ৪টি, বারিক বিল্ডিং মোড়ে দুটি, নিমতলা মোড়ে ২টি, কাস্টমস মোড়ে ২টি, সিইপিজেডে ৪টি, কেপিজেডে ২টি, কাঠগড়ে ২টি ও পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকায় ২টি র্যাম্প থাকবে। চার লেনের এই এক্সপ্রেসওয়ের প্রশস্ততা হবে ৫৪ ফুট। এ ছাড়াও এক্সপ্রেসওয়েতে থাকবে আড়াই হাজার এলইডি লাইট।
সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা গেছে, করোনার ভাইরসের মধ্যেও চট্টগ্রামের লালখানবাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত নির্মাণাধীন প্রায় সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৫৪ ফুট প্রস্থের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পের কাজ থেমে নেই।
বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগরীর লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত বিদ্যমান সড়কের ওপর দিয়ে নির্মিত হচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। দক্ষিণ প্রান্ত থেকে এ কাজ এগিয়ে আসছে উত্তরের দিকে, যা এসে থামবে লালখান বাজার এলাকায়। টাইগারপাস থেকে লালখান বাজার চট্টগ্রামের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন স্থান হওয়ায় এ অংশটুকু উন্মুক্ত রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন নগরবিদদের কেউ কেউ। সে অনুযায়ী পতেঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে শুরু হওয়ার কথা ছিল টাইগারপাসের দেওয়ানহাট ওভারব্রিজ প্রান্ত থেকে।
আপত্তি জানিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)
কিন্তু সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তা এসে মিলছে লালখান বাজার এলাকায় আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে। তবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কতৃপক্ষের (সিডিএ) কর্তৃক বাস্তবায়নধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের লালখানবাজার অংশে ফ্লাইওভার নির্মাণ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে মাঝখানে নকশা নিয়ে কিছুটা জটিলতা দেখা দিলেও সেটার সমাধান হয়েছে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন আবার নতুন করে জঠিলতা তৈরি করেছে। গত ২১ জুন আপত্তি জানিয়ে সিডিএ চেয়্যারম্যান জহিরুল আলম দোভাষের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছে চসিকের প্রকৌশল বিভাগ।
চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ মোজ্জামেল হক স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে– ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসেওয়ে প্রকল্পের অধীনে লালখান বাজার ফ্লাইওভার নির্মাণ হলে লালখান বাজারের সড়কের দৃষ্টিনন্দন পাহাড় দু’টির সৌন্দার্য মলিন হবে। সেখানে ফ্লাইওভার নির্মাণ না করে সমতলে সড়কটি সংযুক্ত করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।’
সিডিএ’র সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওই অংশে পাহাড় না কেটে ফ্লাইওভার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া ওই অংশে ফ্লাইওভারের উচ্চতা ধরা হয়েছে প্রায় ৩০ ফুট। যার জন্য করা হয়েছে নতুন ডিজাইন। নতুন ডিজাইনে বারিক বিল্ডিং থেকে আসা চার লেনের ফ্লাইওভার দেওয়ানহাটে ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রোডে নির্মিত ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের পশ্চিম পাশ দিয়ে এসে টাইগারপাস পার হয়ে বর্তমানে সিটি কর্পোরেশন কার্যালয়ের রাস্তার সামনে পৌঁছাবে। চার লেনের এই ফ্লাইওভার পাহাড়ের দিকে না গিয়ে রাস্তার মাঝখানে থাকবে। পিলারও রাস্তার মাঝখানে হবে।
সিটি কর্পোরেশনের কার্যালয়ের রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছার পর চার লেনের ফ্লাইওভারের দুই লেন ম্যাজিস্ট্রেট কলোনির আগে রাস্তায় নেমে যাবে। বাকি দুই লেন রাস্তার মাঝখান দিয়ে গিয়ে ওয়াসা মোড়ে বিদ্যমান আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের সাথে যুক্ত হবে। এতে বিমানবন্দর রোড ধরে আসা গাড়িগুলো সড়ক পথে অল্প পথ গিয়ে প্রয়োজনে আবারো ফ্লাইওভারে উঠবে কিংবা নিচ দিয়ে চলে যাবে। এই পয়েন্টে ফ্লাইওভারে ওঠা গাড়িগুলোর জন্য রাস্তা ডেডিকেটেড করে দেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, গত ৮ জুন সিডিএ ও চসিকের সমন্বয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে পাহাড়ের সৌন্দর্য অক্ষুন্ন রেখে এবং পাহাড় না কেটে কিভাবে লালখানবাজার থেকে টাইগারপাস অংশে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা যায়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, সিএমপির (ট্রাফিক) অতিরিক্ত কমিশনার শ্যামল কুমার নাথ, সিডিএ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সিএটিএস-এমআইএসটি’র বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক প্রকল্প পরিচালক নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান।
এলিভেডেট এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক চউকের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান জানান, আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের সঙ্গে যুক্ত করে এই উড়াল সড়ক প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন। আমরা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে এমনভাবে কাজ করছি যাতে করে টাইগারপাস থেকে লালখান বাজার এলাকার সৌন্দর্য্য আরও ফুটে ওঠে। তিনি বলেন, টাইগারপাস নিয়ে একটা আবেগ থাকতেই পারে, যেমনটি আমাদেরও আছে। কিন্তু পরিকল্পিত যোগাযোগ ব্যবস্থার স্বার্থে ওই স্থানটিকেও উড়াল সড়কের আওতায় আনতেই হচ্ছে।
আপত্তি প্রসঙ্গে চউকের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বলেন, তারা বলছেন পাহাড় দেখা যাবে না। আমরা পাহাড় উন্মুক্ত রেখে কাজ করব। এখন চসিকের যদি এ বিষয়ে আপত্তি থাকে তাহলে সেটা উধর্ধতন কর্তৃপক্ষ দেখবে।
চউক সূত্র জানায়, ১৬ কি.মি. এক্সপ্রেসওয়ের মোট পিলার হবে ৩৮৯, যার মধ্যে ২৩০টির কাজ শেষ হয়ে আগ্রাবাদ চৌমুহনী পর্যন্ত চলে এসেছে। পতেঙ্গা থেকে কাঠগড় পর্যন্ত এলাকায় গার্ডার এবং স্লাব বসে গেছে। বারিক বিল্ডিং থেকে সল্টগোলা পর্যন্ত এলাকার এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের যে আপত্তি ছিল সেটিরও সুরাহা হয়ে গেছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যেই ৬ একর জায়গা বুঝিয়ে দিয়েছে। বারিক বিল্ডিং থেকে নিমতলা পর্যন্ত এলাকায় বিদ্যমান সড়কের বাইরে দিয়ে উড়াল সড়ক হওয়ার কথা ছিল বন্দরের নিরাপত্তা বিবেচনায়। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুরনো সড়কের ওপর দিয়েই যাবে এক্সপ্রেসওয়ে। ফলে সড়কের পাশে মাত্র ১০ থেকে ১২ ফুট জায়গা নিতে হবে। এতে করে ভবন ও স্থাপনা ভাঙতে হবে কম। নকশা পরিবর্তনে ব্যয় কিছু বাড়লেও তা এখনও পুরোপুরি নিরূপিত হয়নি।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস এ প্রসঙ্গে বলেন, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে অত্যন্ত নান্দনিক নকশা এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি হচ্ছে। এর জন্য কোন পাহাড় কাটতে হবে না। সৌন্দর্য্য নষ্টের প্রশ্নই ওঠে না, বরং এলাকাটি যেন আরও উদ্ভাসিত হয় সেভাবেই হবে এই উড়াল সড়ক।
তিনি বলেন, এক্সপ্রেসওয়ে যদি লালখান বাজার পর্যন্ত না এনে টাইগারপাসের দেওয়ানহাট প্রান্তে থামিয়ে দেয়া হয় তাহলে সেখান থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত এলাকায় প্রতিদিনই যানজট সৃষ্টি হবে। এতে এক্সপ্রেসওয়ের শতভাগ সফল পাওয়া যাবে না। সে কারণেই চার লেনের মূল এক্সপ্রেসওয়ে থেকে র্যাম্প আকারে দুটি অংশ লালখান বাজারে নামবে, অপর দুই অংশ সরাসরি যুক্ত হবে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের সঙ্গে। সাড়ে ৬ কি.মি. দীর্ঘ আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের সঙ্গে মিলে গেলে ১৬ কি.মি. দৈর্ঘ্যরে এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে যাবে সাড়ে ২২ কিমি। বিদ্যমান সড়কে যানজট কমবে এবং নগরবাসী এর সুফল পাবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, মেগাপ্রজেক্টে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন শেখ মুজিব সড়কের আগ্রাবাদ চৌমুহনী থেকে বারেক বিল্ডিং অংশে চলাচলকারী যানবাহন ও পথচারীরা। সড়কটির বিভিন্ন অংশে সৃষ্ট খানাখন্দ নতুন করে মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। পথচারীদের পাশাপাশি রাস্তায় নামামাত্রই বিপদে পড়তে হচ্ছে সড়কে চলাচলকারী যানবাহনকে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, প্রকল্পের নির্মাণকাজের কারণে সৃষ্ট গর্তে যান আটকে যানজটে পড়া কর্মজীবীদের নিত্য দুর্ভোগের পাশাপাশি প্রায়শ ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনাও। সড়কের বেহাল দশায় অনেকটা নাকানিচুবানি খেতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে প্রকল্পের পরিচালক চউকের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বিএনএ’কে জানান, এই প্রকল্পের নির্মাণকাজের কারণে যে নগরবাসীকে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে তা আমরা বুঝতে পারছি। এই দুর্ভোগের কারণে আমরা ক্ষমা প্রার্থনা করছি। তবে এ ক্ষেত্রে আমাদের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি দ্রুত সমাধান করার। আমরা যখন সিমেন্ট ক্রসিং থেকে কাঠগড় অংশে এই নির্মাণকাজ করছিলাম তখন কিন্তু ওই এলাকার বাসিন্দা ও সড়ক ব্যবহারকারীদের ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। মাসখানেক পর মেরামতের কাজ শুরুর পরিকল্পনা আছে। তবে পুরোপুরিভাবে এই ভোগান্তি থেকে মুক্ত হতে নগরবাসীকে আরও তিন মাসের মতো অপেক্ষা করতে হতে পারে।
বিএনএনিউজ/এসজিএন