বিএনএ, চট্টগ্রাম: বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটার মিঠা পানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র চট্টগ্রামের হালদা নদী। এই বিস্তীর্ণ এলাকায় রুই জাতীয় (রুই, কাতাল, মৃগেল ও কালিবাউশ) মা-মাছ ডিম ছেড়েছে। তবে হালদা নদীতে এবার আশানুরুপ ডিম না পাওয়ায় হতাশ হালদা পাড়ের ডিম সংগ্রহকারীরা। পরিবেশ অনূকুলে না থাকা তথা যথা সময়ে বজ্রসহ মুষলধারে বৃষ্টি না হওয়ায় এবং ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করায় পুরোদমে ডিম ছাড়েনি হালদার কার্প জাতীয় মা মাছ।
মঙ্গলবার (২৫ মে) রাত ১১ টার দিকে নমুনা ডিম দেয় মা মাছ। এসময় হালদা পাড়ের ডিম সংগ্রহকারীরা ১০০ থেকে ২০০ গ্রাম পর্যন্ত নমুনা ডিম সংগ্রহ করে। এরপর বুধবার (২৬ মে) সকালেও অল্প পরিমাণ নমুনা ডিম দেখা যায়। তবে বিকেলের দিকে আর ডিম পাওয়া যায়নি। যদিও ডিম সংগ্রহকারীরা নৌকা, জালসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি দিয়ে নদীতেই অপেক্ষা করে। পরে বুধবার রাতে মা মাছ পুরোদমে ডিম ছাড়তে শুরু করে।
আজ বৃহস্পতিবার (২৭ মে) দুপুরে সরেজমিনে গড়দুয়ারা নয়াহাট, উত্তর মাদার্শা মাছুয়াঘোনা হ্যাচারী, শাহমাদারি ও মদুনাঘাট গিয়ে দেখা যায়, হ্যাচারিতে ডিম সংগ্রহকারীরা তাদের আহরিত ডিম কুয়ায় সংরক্ষণ করে রেণু ফোটানোর কাজে ব্যস্ত। প্রতিটা হ্যাচারিতেই কয়েকটি করে কুয়া খালি পড়ে আছে। মাছুয়াঘোনা হ্যাচারিতে ১১২০ কেজি, শাহমাদারিতে ৯০০ কেজি, মদুনাঘাটে ৭৭০ কেজি ও গড়দুয়ারা নয়াহাট কামাল সওদাগরের নিজস্ব মাটির কুয়ায় ৮০ কেজিসহ মোট ১ হাজার ৮৭০ কেজি ডিম সংগ্রহ হয়েছে। যা গতবারের তুলনায় অনেক গুন কম।
এ বিষয়ে হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, এবার এখনও ভারী বৃষ্টি হয়নি। মা মাছ ডিম ছাড়ার জন্যে বৃষ্টি প্রয়োজন। এ ছাড়া নদীতে লবণাক্ত পানির পরিমাণ বেশি। স্বাভাবিকের চেয়ে ৭২ শতাংশ লবণাক্ত পানি থাকায় ডিম সংগ্রহ কম হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিবছর এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে হালদায় মা মাছ ডিম ছাড়ে। পূর্ণিমা ও অমাবস্যা তিথিই ডিম ছাড়ার উপযুক্ত সময়। এসব তিথিতে বজ্রসহ প্রবল বর্ষণের ফলে নদীতে ঢলের সৃষ্টি হয়ে থাকে। বিশেষ করে নদীর উপরি অংশে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, মানিকছড়ি, চট্টগ্রামের উত্তর ফটিকছড়িতে প্রবল বর্ষণের ফলে নদীর সাথে সংযুক্ত ছড়া ও শাখা খালের মাধ্যমে পাহাড়ি ঢল হালদা নদীতে এসে পড়ে। তখন ঢলের সময় মা মাছ ডিম ছেড়ে থাকে। এর মধ্যে এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত তিনটি তিথি/জো চলে গেছে। গতকাল ও পরশুর বৃষ্টিতেই ডিম ছাড়তে শুরু করেছে মা মাছ। গত সোমবার থেকে পূর্ণিমার জো শুরু হয়েছে। আগামী ২৮ মে পর্যন্ত জো’র প্রভাব থাকবে। এপ্রিল মাসে ছাড়া ডিম সবচেয়ে ভালো এবং দ্রুত বর্ধনশীল বলে সংশ্লিষ্টরা উল্লেখ করেন। কিন্তু এখন মে মাসও শেষের পথে।
জানা যায়, এবার ২৪৩ টি নৌকা ও প্রায় ৭’শ ডিম সংগ্রহকারী হাটহাজারীর মাদার্শা এলাকার রামদাস মুন্সিরহাট, অঙ্কুরি ঘোনা, আজিমের ঘাটসহ কয়েকটি পয়েন্টে ডিম আহরণ করছে।
ডিম সংগ্রহকে ঘিরে গতকাল (বুধবার) হালদা পরিদর্শন করেছেন রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী এমপি, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. মুমিনুর রহমানসহ হালদা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ডিম সংগ্রহকারী কামাল উদ্দিন সওদাগর বলেন, পরিবেশ অনূকুলে না থাকা এবং লবণাক্ত পানি প্রবেশ করায় মা মাছ পুরোদমে ডিম ছাড়েনি। আশা করছি সামনের জো’তে (আগামী সপ্তাহের অমাবশ্যায়) বজ্রসহ মুষলধারে বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের ঘোলা পানি প্রবেশ করলে ডিম ছেড়ে দিবে। না হয় এবার বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন ডিম সংগ্রহকারীরা।
আরেক ডিম সংগ্রহকারী রোশাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা যা আশা করেছি সেভাবে ডিম পাচ্ছি না। অল্পসল্প ডিম পেয়েছি মাত্র। ডিম সংগ্রহ করার জন্যে অনেক টাকা খরচ করতে হয়। নৌকা, জাল, কুপ সংস্কার এসবের জন্যে ৫০/৬০ হাজার টাকা খরচ হয়। অনেকের আরও বেশি হয়। তবে আমরা এখনও আশাবাদী।
জানা যায়, হালদা নদী থেকে গত বছর ২২ মে প্রায় ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম আহরণ করা হয়। যা বিগত ১২ বছরের রের্কডকে ছাড়িয়ে যায়। এরআগে ২০১৯ সালের ২৫ মে প্রায় ১০ হাজার কেজি, ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল ২২৬৮০ কেজি, ২০১৭ সালের ২২ এপ্রিল ১৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালের ২ মে ৭৩৫ কেজি, ২০১৫ সালের ২১ এপ্রিল ও ১২ জুন ২৮০০ কেজি, ২০১৪ সালের ১ মে ১৬৫০০ কেজি, ২০১৩ সালের ৫ মে ৪২০০ কেজি, ২০১২ সালে ৮ এপ্রিল ২১২৪০ কেজি, ২০১১ সালে ১৮ এপ্রিল ১২৬০০ কেজি, ২০১০ সালে ২২ মে ৯০০০ কেজি ও ২০০৯ সালে ২৫ মে ১৩২০০ কেজি ডিম আহরণ করা হয়।
চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বলেন, এখনও নদীতে আছেন ডিম সংগ্রহকারী। নদীর পানিতে লবণাক্তের পরিমাণ অনেকটা বেশি। আশাকরি এটা কেটে যাবে।
হালদার পানিতে অতিরিক্ত লবণ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, ওয়াসার ল্যাবরেটরি টেস্টে হালদার পানিতে ৩১ মিলিগ্রাম পার লিটার ক্লোরাইড পাওয়া গেছে। যেখানে সহনীয় মাত্রা হচ্ছে ২০ থেকে ৪০ মিলিগ্রাম পার লিটার। এ কারণে ওয়াসা দৈনিক ৬ কোটি লিটার পানি উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। জোয়ারের সময় পানি উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে।
হাটহাজারী উপজেলার নির্বাহী অফিসার রুহুল আমিন জানান, দুটি কারণে এবার মা মাছ পুরোদমে ডিম ছাড়েনি। এক, পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়া, দ্বিতীয়ত, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সাগরের লবণাক্ত পানি প্রবেশ করা। তবে সামনের জো’তে পরিবেশ অনূকুল হলে পুরোদমে ডিম ছেড়ে দিতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র এ হালদা নদী, ডিম ছাড়ার মৌসুমের তিন মাস পূর্বে কার্প জাতীয় মা মাছ দেশের বিভিন্ন নদ-নদী ছেড়ে হালদার মিষ্টি পানিতে বিচরণ করতে চলে আসে। পরবর্তীতে ডিম দেওয়ার সময় মা মাছেরা এপ্রিল থেকে জুন- এ তিন মাসের অমাবশ্যা ও পূর্ণিমার জো’তে মুষলধারে বৃষ্টি, বজ্র ও পাহাড়ি ঢলে পানির স্রোতে নদীর গভীরতম স্থানে ও বাঁকে ডিম ছেড়ে দেয় হালদায়।
প্রসঙ্গত, খাগড়াছড়ির জেলার বাটনাতলী পাহাড় হতে নেমে সর্পিল ১০৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে হালদা নদী মিলেছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে। প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী বয়ে গেছে হাটহাজারী, রাউজান ও ফটিকছড়ি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। এটি বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটা নদী যেখান থেকে সরাসরি রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে পূর্ণিমায় প্রবল বর্ষণ আর মেঘের গর্জনের পর পাহাড়ি ঢল নামলে হালদা নদীতে রুই জাতীয় মাছ স্মরণাতীত কাল থেকে ডিম ছেড়ে আসছে। এই নদীর সুরক্ষায় সরকার ইতোমধ্যে এটিকে বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ ঘোষণা করেছে। বাড়ানো হয়েছে মনিটরিং কার্যক্রম। বসানো হয়েছে হালদার ৮ পয়েন্টে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন সিসি ক্যামেরা।
বিএনএনিউজ/মনির