।। শামীমা চৌধুরী শাম্মী ।।
বিএনএ, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের আনোয়ারা- কর্ণফুলী উপজেলার রাজনীতি যুগ যুগ ধরে মূলত দুইটি পরিবারই নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলো। দুই সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য আতাউর রহমান খান কায়ছার ও আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু পরিবার। খান ও চৌধুরী পরিবারের রাজনৈতিক এই লড়াইয়ে চৌধুরী পরিবার এগিয়ে ছিল।
গত ১৫ বছর ধরে এককভাবে কর্ণফুলী ও আনোয়ারার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে সাবেক ভূমিমন্ত্রী স্থানীয় সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। এর আগে তার পিতা প্রয়াত সাবেক সংসদ সদস্য আখতারুজামান চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণে ছিলো।
তবে এবারের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও মন্ত্রী পরিষদ থেকে ছিটকে পড়েছেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। এখানেই শেষ নয়। তার বিপরীত মেরুতে এবার মন্ত্রীসভায় অর্থ প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক ওয়াসিকা আয়শা খান।
ফলে আনোয়ারা কর্ণফুলীর রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে। এতদিন যারা আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলার রাজনীতিতে কোণঠাসা ছিলেন তারা দলে দলে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। যোগ দিচ্ছে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা খানের গ্রুপে। তারা ওয়াসিকা খানকে সামনে রেখে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে নিজেদেরকে নতুন করে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। এতে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর সাম্রাজ্য খান খান হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
কিন্তু এটি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। ইতোমধ্যে কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তিনি বলেছেন, নির্বাচিত সংসদ সদস্য হিসাবে সব কিছু তিনিই নিয়ন্ত্রণ করবেন। তার সংসদীয় এলাকায় দ্বৈত শাসন চলবে না। এমন কি সভাসমাবেশ করতে হলে এক সপ্তাহ আগেই পুলিশ থেকে অনুমতি নিতে হবে।
এর পাল্টা জবাবও দিয়েছেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান। এক জনসভায় তিনি বলেছেন, দুর্বৃত্তায়ন থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করে সুস্থ রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাকে হত্যার হুমকী দেয়া হচ্ছে উল্লেখ করে ওয়াসিকা বলেন, ভদ্রতা মানে দূর্বলতা নয়, আমি পালানোর মানুষ নই।
আনোয়ারা-কর্ণফুলী আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বিগত মন্ত্রীসভায় ভূমিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে একই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন। তাঁর পিতা প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু একাধিকবার সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য ছাড়াও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যে কারণে দীর্ঘদিন ধরে আনোয়ারা–কর্ণফুলীর রাজনীতিতে বাবু পরিবারের একক আধিপত্যে নিয়ন্ত্রণ চলে এসেছিলো। কিন্তু আনোয়ারার আরেক বর্ষীয়ান নেতা, আওয়ামী লীগের প্রয়াত প্রেসিডিয়াম সদস্য আতাউর রহমান খান কায়সারের মেয়ে বেগম ওয়াসিকা আয়শা খান অর্থ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর বদলে যেতে শুরু করে কর্ণফুলী ও আনোয়ারা উপজেলার রাজনৈতিক দৃশ্যপট।
ইতোমধ্যে আনোয়ারা কর্ণফুলী উপজেলায় অর্থপ্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা খানকে গণসংবর্ধনা, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস উদযাপন, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে শিকলবাহায় সাম্পান বাইচ ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গণজোয়ার দেখা গেছে। ফলে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপি’র একক সাম্রাজ্যে রাতারাতি ফাটল দেখা যাচ্ছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে। দলে দলে উপজেলায় দীর্ঘদিন নিস্ক্রিয় থাকা নেতাকর্মীরা নৌকায় পাল তুলতে শুরু করেছে। অসংখ্য ত্যাগী নেতা অর্থ প্রতিমন্ত্রীর হাতে ফুল দিয়ে তাঁর নেতৃত্বে কাজ করতে অঙ্গীকার করেছেন।
বিশেষ করে এতদিন যারা সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বলয়ে উপেক্ষিত ও বঞ্চিত ছিলেন তাঁরা অর্থ প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে তৃণমূল আওয়ামী লীগ নামে সভা সমাবেশ করে নতুনভাবে সংগঠিত হতে শুরু করেছেন। দিনদিন এই তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি আবুল কালাম চৌধুরী, আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি কাজী মোজাম্মেল, হাইলধর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নাজিম উদ্দীন, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা জাতীয় শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের সদস্য ইঞ্জিনিয়ার ইসলাম আহমেদ, কর্ণফুলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি শিকলবাহা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, সহ-সভাপতি এস. এম ছালেহ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মহিউদ্দিন মাইজভান্ডারী, চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী ও জুলধা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী নুরুল হকসহ অনেকে। যাদের রয়েছে বিশাল কর্মীবাহিনী।
আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি কাজী মোজাম্মেল হক বলেন, আনোয়ারার রাজনীতির দৃর্বৃত্তায়নের শিকার হয়েছেন তিনি। ২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করায় খুনের মামলার আসামী করা হয়েছে। তিনিসহ ৩২ জনকে আসামী করে ৪ মাস কারাগারে রেখেছেন সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান চৌধুরী।
দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি আবুল কালাম চৌধুরী বলেন, হাইব্রিড আওয়ামী লীগের অত্যাচারে তৃণমূল আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরা নির্বাসিত। তারা ওয়াসিকা খানের নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে চায়।
দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য অধ্যাপক ডাক্তার নাসির উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ত্যাগী নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে কর্ণফুলী ও আনোয়ারা উপজেলার রাজনীতিতে বিএনপি জামায়াত নেতাদের পদ পদবি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই অবস্থার অবসান জরুরি বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।
বিএনএনিউজ/ বিএম