গত ৫ আগষ্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। পালিয়ে যেতে বাধ্য হন সাড়ে ১৬ বছর টানা দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা শেখ হাসিনা। এরপর ৮ আগষ্ট থেকে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পান নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকে নেপথ্যে যুক্ত ছিলেন জামায়াত ইসলামী ও তাদের সহযোগী ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। অর্ন্তবতীকালীন সরকারের দেড় মাসের মাথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে তাদের অবস্থান থাকার বিষয়টি প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। তারা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজেদের দখলদারিত্ব বজায় রাখতে তাদের আদর্শের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করে।
তারই ধারাবাহিকতায় এবার চট্টগ্রামের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র দাবী করে ইসলামী ছাত্র শিবিরের বহিরাগতরা ঐতিহ্যবাহী হাজেরা-তজু ডিগ্রি কলেজে মঙ্গলবার বেলা ১২টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে অবস্থান নিয়ে চরম নৈরাজ্য চালায়। তারা উপাধ্যক্ষকে অস্ত্রের মূখে পদত্যাগে বাধ্য করেছে। তার আগে অধ্যক্ষকে দিয়ে কলেজের তিন সিনিয়র শিক্ষককে বরখাস্ত করতে বাধ্য করে। যে তিন শিক্ষককে বরখাস্ত করতে বাধ্য করা হয়েছে তারা হলেন- মো. দবির উদ্দিন, মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন ও একেএম ইসমাইল। তিনজনই এই কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ। তারা দক্ষ ও অভিজ্ঞ হওয়ায় কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ভালো ফলাফলের স্বার্থে রেখে দিয়েছিল।
কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ চয়ন দাশ বলেন, বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে এ অরাজকতা সৃষ্টি করেছে। তারা অন্যায়ভাবে কোনো যুক্তি ছাড়াই ভয়ভীতি দেখিয়ে উপাধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে। বাধ্য করা হয়েছে তিন শিক্ষকের বরখাস্ত আদেশে স্বাক্ষর করতে।
তিনি আরও বলেন, যারা শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলেছে তারা সবাই বহিরাগত। কলেজের শিক্ষার্থীরা এমন ঘটনা ঘটাতে পারে না। তাছাড়া জোরপূর্বক পদত্যাগ বা বরখাস্ত আদেশে স্বাক্ষর নেওয়া হলেও তার কোনো বৈধতা নেই বলে জানান অধ্যক্ষ।
প্রসঙ্গত, কথিত বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আসা ছাত্রদের হত্যার হুমকিতে একপর্যায়ে কলেজের উপাধ্যক্ষ এসএম আইয়ুব অসুস্থ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। দ্রুত উদ্ধার করে সহকর্মীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। এই ঘটনায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত সাধারণ ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রয়া দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন শিক্ষককে মারধর, পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য এক দফার আন্দোলনে শহীদরা রক্ত দেয়নি।
কলেজ কর্তৃপক্ষের অভিযোগ গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকেই এ কলেজে অস্থিরতা তৈরির অপচেষ্টা চালিয়ে আসছিল ইসলামী ছাত্র শিবির।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৩৪ বছরের পুরোনো প্রতিষ্ঠান হাজেরা-তজু ডিগ্রি কলেজ। এটি নগরীর চান্দগাঁও এলাকায় অবস্থিত। এই কলেজে ৫ হাজারের মতো শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন শতাধিক। রাজনীতিমুক্ত কলেজ হিসেবেই জনপ্রিয় এই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি তার মা বাবার নামে ব্যক্তিগত অর্থায়নে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি চট্টগ্রামে যে ৪০টির মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন- হাজেরা-তজু ডিগ্রি কলেজ তার অন্যতম। বিশাল ক্যাম্পাসের সব জমি একটি ভবন তার অর্থায়নে করা হয়েছে। সরকারের অর্থায়নে করা হয়েছে মাত্র একটি ভবন।
প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী হাজেরা-তজু ডিগ্রি কলেজের গভর্নিং কমিটি বাতিল করা হয়। মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসাইনকে প্রধান করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর একটি নতুন অ্যাডহক কমিটি অনুমোদন দেন। কিন্তু এক সপ্তাহ না যেতে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার পূর্বের অ্যাডহক কমিটি বলবৎ থাকা অবস্থায় আরেকটি অ্যাডহক কমিটি গঠন করেন। এই কমিটির সভাপতি করা হয় জামায়াত ইসলামীর অনুসারি চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নূরীকে। তার আগে জামায়াত ইসলমীর দুই নেতা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে গিয়ে এই ব্যাপারে বৈঠকও করে। তাদের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় অরাজনৈতিক এই কলেজটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে চট্টগ্রামের ছাত্র রাজনীতিতে একক নিয়ন্ত্রণকারি হতে তৎপর রয়েছে বলে অভিযোগ হাজেরা তজু কলেজের প্রতিষ্ঠাতা নুরুল ইসলাম বিএসসি পরিবারের।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য গঠিত অ্যাডহক কমিটির প্রধান মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসাইন বলেন, তাকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারণ করায় তিনি কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করছেন না। এ বিষয়ে জানতে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার নুরুল্লাহ নূরীর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিএনএনিউজ,শামীমা চৌধুরী শাম্মী/এইচমুন্নী