।।মনির ফয়সাল।।
যুদ্ধের ইতিহাসে সবসময়ই প্রাধান্য পায় সৈনিকদের সাহসিকতা বা রাজনৈতিক ঘটনাগুলো, অবহেলিত হয় নারীদের অবদান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও এর ব্যাতিক্রম খুব একটা হয়নি। বাঙ্গালি নারীরা যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক অবদান রেখেছেন যা অবিস্মরণীয়। তাঁরা রিফুজিদের সেবায় দিন রাত এক করে দিয়েছেন, এমনকি অস্ত্র হাতে যুদ্ধও করেছে মুক্তি বাহিনীর হয়ে। কিন্তু তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা থেকে তাঁরা আজও অনেকটাই বঞ্চিত।
১৯৭১ সালের মার্চের প্রথম থেকেই দেশের প্রতিটি অঞ্চলে যে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় তাতে নারীদের বিশেষ করে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যে সকল নারী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পগুলোর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ছিল গোবরা ও লেম্বুছড়া ক্যাম্প। তাছাড়া উইমেন্স কো-অর্ডিনেটিং কাউন্সিলের প্রশিক্ষণ, মেজর জিয়াউদ্দীন বাহিনীর প্রশিক্ষণ, মেজর জলিলের নারী বাহিনীর প্রশিক্ষণ ও সিরাজ সিকদার বাহিনীর ক্যাম্প প্রশিক্ষণও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের যে সকল নারী সাহসিকতা নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ডা. সেতারা বেগম ও তারা ভানু বিবিকে (তারামন বিবি) বাংলাদেশ সরকার বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত করে। তাছাড়াও সম্মুখ যুদ্ধে যে সকল নারীর কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের কথা জানা যায়, তাঁদের মধ্যে ক্যাম্প কর্মী বেনিলাল দাস গুপ্ত, শোভারানি মন্ডল, কাঁকন বিবি (খাসিয়া গোষ্ঠীর সদস্য), শিরিন বানু, বীথিকা বিশ্বাস, মিনারা বেগম ঝুনু, গীতশ্রী চৌধুরী, আলেয়া বেগম, ফেরদৌস আরা বেগম, আশালতা বৈদ্য, রওশন আরা বেগম, জিন্নাত আরা, করুণা বেগম, মেহেরুন্নেসা মিরা প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুক্তিয্দ্ধুকালে নারী মুক্তিযোদ্ধাগণ বিশেষভাবে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে অস্ত্র সংগ্রহ ও সরবরাহ ও তথ্য আদান প্রদান করতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ ও সরবরাহ করতে গিয়ে অনেক নারী পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বেগম মুসতারী শফী, শ্রীমতি মিনা বিশ্বাস, জাহানারা ইমাম, বেগম সুফিয়া কামালের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এই যুদ্ধচলাকালীন সময়ে ক্যাম্পে তাদের খাওয়া, থাকায় অবর্ননীয় কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে কিন্তু কোন কিছুই তাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। একজন নির্ভিক নারী হলেন তারামন বিবি। তারামন বিবি ১১ নং সেক্টরের ক্যাম্পে (ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল ক্যাম্প) আবু তালেবের নেতৃত্বে যোগ দেন প্রথমে একজন রাঁধুনি এবং বুয়া হিসেবে। কিন্তু তাঁর সাহস, শক্তি ও উদ্যম দেখে মুহিব হায়দার তাকে যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন এবং তাকে শেখান কিভাবে রাইফেলস বা স্টেইন গান চালাতে হয়। তারামন বিবি তাঁর কমরেডদের সাথে মিলে শত্রুবাহিনীদের গানবোটে হামলা চালান যেখানে পাকিস্তানীদের নৌকা বোঝাই অস্ত্র ছিল। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। তিনি ছিলেন একমাত্র সবচেয়ে কমবয়সী নারী যিনি সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন এবং পরে বীর প্রতীক সম্মানে ভূষিত হন তাঁর সাহসী অবদানের জন্য।
‘বাংলাদেশী হসপিটাল’ নামে আগরতলার ত্রিপুরায় ৪৮০ বিছানার হাসপাতালে অনেক নারী যুদ্ধাহতদের সেবা করেছেন স্বাধীনতা যুদ্ধে। এখানে তাঁরা যুদ্ধে আহত সৈনিকদের ভালো হওয়ার জন্য অক্লান্ত ভাবে সেবা শুশ্রূষা করতেন। এই নারীরা তাদের মন ও পুরো সত্তা দিয়ে রাতদিন মুক্তি বাহিনীদের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন এবং শুধু সেবা না, নানাভাবে তাদের সান্ত্বনাও দিতেন। তাঁদের এই অবদান যুদ্ধে অংশগ্রহণের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। এই গ্রুপটির তত্ত্বাবধায়নে যিনি ছিলেন তিনি হলেন ডক্টর সিতারা বেগম, তারামন বিবির সাথে ইনিও বীর প্রতীক উপাধি পান তাঁর অসাধারন নেতৃত্বের জন্য। উনার পরিচালনাতেই ৪০০ জন শেষ বর্ষের ছাত্র বিদেশি ডাক্তারদের সাথে মিলে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আহত মুক্তি বাহিনী ও ইন্ডিয়ান আর্মি অফিসারদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। তারামন বিবি এবং ডক্টর সিতারা বেগমের মতো আরও অগুনিত নারীদের অসীম সাহস ও অবদান রয়েছে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে কিন্তু আমরা তাঁদের মনে রাখিনি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা নিপীড়িত হয়েছিলেন একাত্তরের জননী গ্রন্থের লেখক চট্টগ্রামের রমা চৌধুরী। ২০১৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। গোটা জীবন একা হেঁটেছেন রমা চৌধুরী। ১৯৪১ সালের ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার পোপাদিয়া গ্রামে জন্ম।
তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী, যিনি ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর ১৯৬২ সালে কক্সবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্ধকার নেমে আসে তিন সন্তানের জননী রমা চৌধুরীর জীবনে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁর সন্তান ও মায়ের সামনে তাঁকে চরমভাবে লাঞ্ছিত করে। শুধু নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাঁর বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল। পাকিস্তানি দোসরদের হাত থেকে পালিয়ে পুকুরে নেমে আত্মরক্ষা করেন। এর পরের ইতিহাস আরো কষ্টের, আরো বেদনার। স্বামী তাঁকে ছেড়ে ভারতে চলে গেলেন। নিজের সম্ভ্রম হারানোর ভয়ংকর ঘটনাকে আড়াল করে তিনি তিন শিশুসন্তান ও মাকে নিয়ে পথে পথে ঘুরেছেন। সে সময় তিনি পাননি কোনো আশ্রয় ও সহযোগিতা। এই সমাজ তাঁকে সহজভাবে গ্রহণ করেনি।
দুঃখজনক হলেও সত্যি এইসব নারীদের সাহস ও ত্যাগ আমাদের উদ্বুদ্ধ করে ঠিকই কিন্তু যুদ্ধের পর তাঁরা যেন পরিত্যাক্ত, তাঁদের এতটুকু সম্মান বা সাহায্য মেলেনি যুদ্ধের পরে। স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাস প্রায় ২ লাখ বা তারও বেশি মা –বোনেরা ধর্ষিত হয়েছে পাকিস্তানি মিলিটারি ও রাজাকার দ্বারা। ৭ থেকে নিয়ে ৭০ বছরের মেয়ে বা নারীরা একা বা দলীয়ভাবে ধর্ষনের শিকার হয়েছে এমনকি তাঁদের পরিবারের সামনেও। ধর্ষণের পর কাউকে মেরে ফেলা হয়েছে আবার কাউকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পাকিস্তানি ক্যাম্পে লাগাতার ধর্ষণের জন্য। কিছু কিছু তরুনীদের এমনভাবে শারীরিক নির্যাতন ও ধর্ষণ করা হয়েছে যে তাঁরা আর কোনোদিন মাও হতে পারবেনা। আবার কেউ কেউ লজ্জায় আত্মহত্যা ও গর্ভপাত করতে বাধ্য হয়েছে। ২২শে ডিসেম্বর, বিজয়ের কিছুদিন পরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এইসব ধর্ষিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি দেন যার অর্থ হচ্ছে – সাহসী নারী বা যুদ্ধের নায়িকা। এই উপাধি দেয়া হয়েছিল এই নারীদের আত্মত্যাগের জন্য তাঁদের সম্মান জ্ঞাপনে। কিন্তু এই উপাধি তাঁর প্রতিজ্ঞা ধরে রাখেনি। এইসব নারীরা সম্মানের বদলে পেয়েছে মানুষের কটূক্তি, বঞ্চনা ও গঞ্জনা। এই উপাধি যেন লজ্জার। আর যেসব রাজাকার তাঁদের ধর্ষণ করেছে তাঁরা পেয়েছে সমাজে সম্মান, উঁচু জায়গা, কেউ আবার পেয়েছে মুক্তিযোদ্ধার খেতাব। এর চেয়ে বড় লজ্জা একটা জাতির জন্য আর কি হতে পারে।!? বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীর ভূমিকা একজন পুরুষের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। তাঁরা তাঁদের ইজ্জত খুইয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে, তারপরও তাঁরা নিজেদের দুঃখ ভুলে সাহায্য করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের, আহতদের সেবা করেছে, অন্ন ও বস্ত্র জোগাড় করে মুক্তি বাহিনীকে দিয়েছে, রিফুজি ক্যাম্পে বাচ্চাদের দেখাশোনা করেছে, রাতে নিজের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে নিজে সারারাত জেগে পাহারা দিয়েছে। একজন নারীই বোধহয় পারে এতোরূপে এতোভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিতে।
স্বাধীনতা যুদ্ধে এভাবেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলার নারী সমাজ তাদের সর্বংসহা চরিত্র থেকে বেরিয়ে এসে পাকিস্তান সেনাবহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন। আর এভাবেই বাংলার বীর নারীদের সাহসী পদক্ষেপ, সেবা ও সহায়তা আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে রেখেছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শুধু মুক্তিযুদ্ধে নয়, দেশ গঠনসহ প্রত্যেকটি কাজে নারীরা পুরুষের পাশাপাশি অবদান রেখে কাজকে আরো বেশি ত্বরান্বিত করেছেন। যেখানে পুরুষের অবদান রয়েছে সেখানে নারীরও অবদান রয়েছে। নারীর এই স্বতঃস্ফূর্ত অবদানকে আমরা কোনো ক্রমেই অস্বীকার করতে পারবো না। তাই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন-“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণ কর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, আর অর্ধেক নর।”
বিএনএনিউজ/