বিএনএ ডেস্ক : ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সময়ে শত শত ব্যবসায়িকে যৌথবাহিনী গ্রেপ্তার, জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করেছে। অনেক ব্যবসায়ি দেশ ছেড়েছিলেন। যারা দেশ ছাড়তে পারেননি তারা দেশেই নিরাপদ জায়গায় আত্মগোপন করেছিলেন। ফলশ্রুতিতে শুধুমাত্র ব্যবসায়িদের অসহযোগীতার কারণে সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দিন- মঈনউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। ফলে তারা জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং ক্ষমতা ছেড়ে দিতে এক প্রকার বাধ্য হয়।
গত ৫ আগষ্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ক্ষমতাসীন হয়েছে, বিশ্ব বরেণ্য অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল প্রধান উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূসের সরকার অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে। সিন্ডিকেট মুক্ত করবে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি লাগাম টেনে ধরবেন। কিন্তু মানুষের প্রত্যাশায় গুড়ে বালি! অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের আমলের একশত দিনেও দ্রব্য মূল্য নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বরং বেড়েই চলেছে। এর অন্যতম কারণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবসায়িদের আস্থায় নিতে পারছেন না।
প্রসঙ্গত, গত ১৫ বছরের বেশি সময় থেকে দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থিত ব্যবসায়িরা। কিন্তু রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ সমর্থিত ব্যবসায়িদের ফ্যাসিবাদী আখ্যা দিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠানে হামলা, মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার ও হয়রানি করা হচ্ছে। ফলে দেশের বেশিরভাগ ব্যবসায়িরা আত্মগোপনে চলে গেছে। লাটে ওঠেছে তাদের ব্যবসা। ব্যাংক লোন দিতে না পেরে লাখ লাখ প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ব্যবসা বন্ধ থাকায় কর্মীদের মাসের পর মাস বেতন দিতে পারছেন না। চলছে কর্মী ছাঁটাই। ফলে দেশের অর্থনীতি চরম সংকটের মুখোমুখি।
আসন্ন রমজানে দেশ কঠিন সংকটে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন শিল্প-বাণিজ্য বিষয়ক বিশ্লেষকরা। তাঁদের মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারণে স্থানীয় শিল্পে স্থবিরতা, অন্যদিকে নানা জটিলতায় আমদানি কমে যাওয়ায়, বাড়তি চাহিদার বিপরীতে পণ্য সরবরাহে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় ব্যবসাবাণিজ্যে গতি ফেরাতে সবরকম ভীতি কাটিয়ে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ব্যবসায়িদের অভিযোগ, ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরও ব্যবসাবাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত হয়নি। উল্টো ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তাদের ওপর নানামুখী চাপ অব্যাহত থাকায় নতুন বিনিয়োগ অনেকটা স্থবির হয়ে আছে।
ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট, আইনশৃঙ্খলায় অস্বস্তিসহ নানা কারণে উৎপাদনে গতি ফেরেনি। বরং কারখানায় হামলা, হয়রানিমূলক মামলা, ব্যাংক হিসাব জব্দ, বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং ভিত্তিহীন নানা প্রচারে ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে, ব্যাংক ঋণের বেশ কিছু নিয়ম পরিবর্তন করায় প্রকৃত ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন। দীর্ঘদিন ব্যবসা করেও যাঁরা কখনো খেলাপি হননি, নতুন নিয়মের ফাঁদে পড়ে তাঁরাও এখন খেলাপির তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করে একজন ব্যবসায়ি বলেছেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে গিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভিন্ন মতের ব্যবসায়িদের হাত-পা বেঁধে ফেলেছেন। ফলে প্রকৃত ব্যবসায়িরা এখন ব্যবসাবাণিজ্য ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন। যার প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। মুদ্রাস্ফীতির যাতাকলে পড়ে জনজীবনে নাভিশ্বাস ওঠেছে।
এমন অবস্থার জন্য দায়ী আমলা-ব্যবসায়ি সংঘাত।
আমলারা মনে করেন, ব্যবসায়িদের আইনের আওতায় নিয়ে আসলেই দেশের অর্থনীতির গতি সচল হবে। বাস্তবে হয়েছে তার উল্টো!
ব্যবসায়ীরা বলছেন, পুজিবাদী গণতন্ত্রে জাতি গঠনে বড় ধরনের অবদান রয়েছে তাদের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রমাণ।
এসিসোসিয়েট প্রেসের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ইলন মাস্ক ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০২৪ এর নির্বাচনী প্রচারণায় প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছেন। তবে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা শেষ হওয়ার আগেই ইলন মাস্কের সম্পদ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে।
৪ নভেম্বরের আমেরিকার ইলেকশনের পর, ফলাফল প্রকাশের দিন ইলন মাস্কের সম্পদ বেড়েছিল প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার। ২৩ শে নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত তার সম্পদ বেড়েছে প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার!
এতে স্পষ্ট, যতই বলা হোক না কেন ডেমোক্রেসি ইজ ফর দ্যা পিপল, অফ দ্যা পিপল, বাই দ্যা পিপল, দিন শেষে দেশে বলুন কিংবা গণতন্ত্রের ধারক বাহক আমেরিকা বলুন— সবখানেই ডেমোক্রেসি ইজ ফর দ্যা ক্যাপিটালিস্ট, বাই দ্যা ক্যাপিটালিস্ট, অফ দ্যা ক্যাপিটালিস্ট।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি -এর সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, ‘দেশের সব রকম ব্যবসাবাণিজ্যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে অস্বস্তি বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকারকে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। গণ মামলা থেকে ব্যবসায়িদের অব্যাহতি দিয়ে তাদের ব্যবসা করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, শুধু আমদানী শুল্ক কমিয়ে দেশের অর্থনীতি সচল ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা সম্ভব নয়। ভিন্ন মতের ব্যবসায়ীরা তাঁদের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে না পারলে কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। সেই সঙ্গে কমে যাবে সরকারের রাজস্ব। এতে প্রতিবিপ্লব বা দ্বিতীয় বিপ্লবের সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না।
বিএনএ/ সৈয়দ সাকিব,ওজি