আর করিম চৌধুরী
বিএনএ ডেস্ক: জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২২তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ সালের ২৫ মে) অবিভক্ত বাংলার (বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ) বর্ধমান জেলার আসানসোলের জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মেছিলেন কাজী নজরুল। তার ডাক নাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। বাবার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুন।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের এক অবিসংবাদিত প্রাণপুরুষ, বিংশ শতাব্দীর এক অগ্রণী শিল্প-শ্রষ্টা। অন্যায়-অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে ক্ষুরধার লেখনি দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। তার জীবন ছিল দু:সাহসিক অভিযাত্রীর ন্যায়। পারিবারিক সীমাহীন দুঃখ কষ্টের মধ্যে থেকেও নির্বাক হওয়া পর্যন্ত সাহিত্য-চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন কাজী নজরুল। তিনি ছিলেন বিস্ময়কর বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী। তার সাহিত্যে উচ্ছাস ও স্বত:স্ফুর্ততা এক অনন্য সৌন্দর্যময়তায় বিশিষ্ট শিল্পরুপ ধারণ করেছে। বাংলা সাহিত্যে নবযুগের সূচনা করেন তিনি। সুন্দরের প্রেরণাতেই অন্যায়, অবিচার ও অসুন্দরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন কাজী নজরুল।
তিনি দেশের স্বাধীনতা ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলমকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে কারাগারে নির্যাতন সহ্য করতেও দ্বিধা করেননি। তার রচনায় ধ্বনিত হয়েছে শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির বার্তা। মানবতার মুক্তির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সোচ্চার। মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তার পক্ষে কলম ধরেছেন নির্ভীক চিত্তে।
তিনি ছিলেন একাধারে শ্রমিক, সৈনিক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গীতিকার, সুরকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী নির্ভিক কণ্ঠস্বর এবং একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক যোদ্ধা। তার কবিতা ও গান বাঙালিকে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।
তার প্রকৃতি, মানবপ্রেমে এবং ভক্তিমূলক গান অনন্য বৈচিত্রময় সুর ও বাণীর সংমিশ্রণে এক অনবদ্য স্বপ্নিল পরিবেশ সৃষ্টি করে। যে গানের আবেদন চিরকালীন ও অবিনশ্বর।তিনিই প্রথম বাংলা গজলের প্রবর্তন করেন এবং একে উত্তর ভারতীয় রাগসংগীতের দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করেন। দারিদ্রের কশাঘাতে জর্জরিত হয়েও তিনি কখনো আপস করেননি। মাথা নত করেননি লোভ-লালসা, খ্যাতি, অর্থ-বিত্ত ও বৈভবের কাছে। ‘চির উন্নত মম শির’ বলে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। জাতীয় কবির চেতনা ও আদর্শ চিরভাস্বর হয়ে আছে বাঙালির জীবনে।
কবি নজরুল তার ৭৭ বছরের জীবনকালের ৩৪ বছরই ছিলেন নির্বাক (১৯৪২-১৯৭৬)। বেঁচে থাকার জীবন সংগ্রাম, অভাব-অনটন, নানা প্রতিকূলতা, জেলজুলুম ও হুলিয়ার মধ্যেই তার সাহিত্যচর্চার সময় ছিল মাত্র ২৪ বছর (১৯১৯-১৯৪২)।
২৪ বছরে নজরুল সৃষ্টি করে গেছেন ২২টি কাব্যগ্রন্থ, সাড়ে ৩ হাজার, মতান্তরে ৭ হাজার গানসহ ১৪টি সংগীত গ্রন্থ, ৩টি কাব্যানুবাদ ও ৩টি উপন্যাস গ্রন্থ, ৩টি নাটক, ৩টি গল্পগ্রন্থ, ৫টি প্রবন্ধ, ২টি কিশোর নাটিকা, ২টি কিশোর কাব্য, ৭টি চলচ্চিত্র কাহিনীসহ অসংখ্য কালজয়ী রচনা।
তাই তো একাধারে তিনি কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, শিশু সাহিত্যিক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, সাংবাদিক, গীতিকার, সুরকার, স্বরলিপিকার, গীতিনাট্যকার, গীতালেখ্য রচয়িতা, চলচ্চিত্র কাহিনীকার, চলচ্চিত্র পরিচালক, সঙ্গীত পরিচালক, গায়ক, বাদক, সঙ্গীতজ্ঞ ও অভিনেতা।
১৯৪১ সালের শেষের দিকে কবি যখন নন্দিনী চলচ্চিত্রের সংগীত রচনা ও সুরারোপ নিয়ে ব্যস্ত, তখন হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে লুম্বিনী পার্ক ও রাচি মেন্টাল হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলে। ১৯৫৩ সালে কবিকে পাঠানো হয় ইংল্যান্ড ও জার্মানিতে। কিন্তু ততদিনে সবই শেষ। বাকশক্তি একেবারেই হারিয়ে ফেলেন তিনি। সেই ১৯৫৩ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত নির্বাক ও অসুস্থ অবস্থায় কলকাতায় অনেকটা অনাদরে নীরবে-নিভৃতেই কাটে কবি নজরুলের জীবন।১৯৭২ সালে তৎকালীন জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার তাকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসে।
১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট (১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) ঢাকায় (সাবেক পিজি হাসপাতালে) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কবি নজরুল। তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। এখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন তিনি।
এদিকে, সাম্য, দ্রোহ ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলামকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করছে জাতি। মঙ্গলবার(২৫ মে) ভোর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে কবির অন্তিম শয্যা ভরে উঠেছে অগণিত মানুষের নিবেদন করা ফুলে।
এবারও জাতীয় পর্যায়ে রাজধানীসহ কবির স্মৃতিধন্য চট্টগ্রাম, ত্রিশাল-দরিরামপুর, কুমিল্লা ও দৌলতপুরে তিন দিনব্যাপী নজরুলজয়ন্তী উদযাপিত হচ্ছে।
জাতীয় পর্যায়ে জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে প্রতিবছর ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও এ বছর করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে না। তবে এ উপলক্ষে সোমবার(২৪ মে) থেকেই শুরু হয়েছে দুই দিনব্যাপী ‘আমিই নজরুল আর্ন্তজাতিক নজরুল উৎসব’। নজরুলের সাম্যবাদ নিয়ে এ আয়োজন করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংগঠন ‘মুক্ত আসর’। উৎসবে অংশগ্রহণ করেছেন বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও পর্তুগাল থেকে ৩২ জন নজরুল গবেষক, লেখক ও নজরুল সংগীত শিল্পী ।
বিএনএনিউজ
