বিএনএ ডেস্ক : গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান সেদিন। এরপর দেশের দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনীতি ও রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ করছে। সংস্কার কাজ শেষে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে।সেই নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে অন্তর্বর্তী সরকার।
এরমধ্যেই এক-এগারোর ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার আপগ্রেড ভার্সন ‘মাইনাস ফোর’ এর বিষয়ে রাজনীতির অন্দর মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে। যদিও বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই ধরণের সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিচ্ছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবুও এখন এই ‘মাইনাস টু কিংবা মাইনাস ফোর’ ফর্মুলাটি আলোচনায় এসেছে। বিশেষ করে নির্বাচন দীর্ঘায়িত হওয়ার প্রেক্ষাপট, সংস্কার কমিটিতে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধির অনুপস্থিতি, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার বিষয় ঘিরেই এমন জল্পনা-গুজব ক্রমে ডালপালা মেলছে।
‘মাইনাস টু’ বলতে প্রধান দুই দলের শীর্ষ নেত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়াকে বোঝানো হয়। তবে ‘মাইনাস ফোর’ এর বাকি দু’জন কারা? সেটি পরিষ্কার না হলেও ওই দুজন হলেন দুই নেত্রীর ছেলে তারেক রহমান এবং সজীব ওয়াজেদ জয়।
প্রসঙ্গত, গত ৪ নভেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ২০০৭ সালে ১/১১-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় বিরাজনীতিকরণে এবং মাইনাস-টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের ব্যর্থ চেষ্টা হয়েছিল। “সেই পথ অনুসরণ করার কথা চিন্তাও করা উচিত নয়। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, বিএনপিকে কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। কারণ বাংলাদেশের জনগণ কখনোই তা মেনে নেবে না। আওয়ামী লীগ বিএনপিকে নানাভাবে ভাঙার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে, ভবিষ্যতেও পারবে না,”।
এছাড়া, সম্প্রতি বিএনপির অন্যতম সিনিয়র নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বক্তব্যে ‘এক-এগারো এবং মাইনাস টু’ প্রসঙ্গটি এসেছে। এক-এগারোর মতো বিরাজনীতিকরণের চক্রান্ত চলছে বলে বক্তব্য দেন তিনি।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার কথা থাকলেও তিনি এখন যাচ্ছেন না। অন্যদিকে লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে নাগাদ দেশে ফিরতে পারবেন তাও এখনো দলটি নিশ্চিত হতে পারেনি।
কিছু মামলা থেকে তিনি অব্যাহতি পেলেও সব আইনি বাধা অপসারণে প্রশাসনিক ধীরগতিতে দলের অনেকের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যেই সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কারও কারও বক্তৃতায় শুধুমাত্র ভোটের জন্য কিংবা এক ফ্যাসিবাদকে সরিয়ে অন্য ফ্যাসিবাদকে ক্ষমতায় আনার জন্য ছাত্ররা জীবন দেয়নি—এমন সব বক্তব্য বিএনপিকে ইঙ্গিত করে দেয়া হয়েছে বলে মনে করছেন দলের নেতারা।
গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনীতি ও রাষ্ট্র সংস্কারের বড় দাবি রয়েছে আন্দোলনকারীদের। ২০০৭ সালে এক-এগারোর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারও রাজনীতিতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিল। সে সময় আলোচিত হয়েছিল ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’।
তৎকালীন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কর্মকর্তা, সেনাপ্রধানসহ অনেকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মহিউদ্দিন আহমদ। এ সময় রাজনীতিতে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার বিষয়টি বিশেষভাবে জানার চেষ্টা করেছেন। তার ‘এক এগারো’ গ্রন্থে আলাদা একটি অধ্যায় রয়েছে ‘মাইনাস টু’ শিরোনামে।
মহিউদ্দিন বলেন, যখন এক-এগারো নিয়ে বই লিখি তখনতো আমি ব্রিগেডিয়ার বারী ও জেনারেল মইন- এদের ইন্টারভিউ করেছিলাম। আমি একবার চৌধুরী ফজলুল বারীকে প্রশ্ন করলাম, আপনারা ‘মাইনাস টু’ কেন চাচ্ছিলেন? তিনি বলেন যে আমরা কখনো ‘মাইনাস টু’র কথা বলি নাই, এটা মিডিয়ার সৃষ্টি। আমরা চেয়েছিলাম মাইনাস ফোর।
আবারও মাইনাস ফর্মুলা আলোচিত হওয়া এবং এর সঙ্গে খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়ার সম্পর্ক আছে কি না- সেটি নিশ্চিত নয়। তবে মহিউদ্দিন আহমদের ধারণা মাইনাস ফর্মুলার একটা বিবেচনা থাকলেও থাকতে পারে।
মহিউদ্দিন বলেন, ‘ফোরের মধ্যে মাইনাস ওয়ান হয়ে গেছে ২০০৮ এ। আর পাঁচই আগস্ট আরও দুজন হয়ে মাইনাস থ্রি কমপ্লিট। এখন যদি খালেদা জিয়া বিদেশে চলে যান, তাহলে মাইনাস ফোর হয়ে যাবে। ওইটার ধারাবাহিকতাই আমার মনে হচ্ছে।’
তবে ‘মাইনাস ফর্মুলার’ বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও মুখপাত্র সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি মনে করেন, ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেন সরকারের সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা চলে না।
তিনি বলেন, ‘আমি জানি না কেউ এগুলো উচ্চারণ করে কি না। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এটা জনগণের সরকার। এটা গণঅভ্যুত্থান, গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট জনগণের সরকার। সুতরাং এখানে মাইনাস ফর্মুলার কোনো অস্তিত্ব এখানে নেই। এই সরকার আমাদেরই সরকার। আমরা এই সরকারকে সহযোগিতা করি। এই সরকারকে ওউন করি।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনকে দৃশ্যত কম গুরুত্ব দেয়া আর বিএনপিকে ইঙ্গিত করে উপদেষ্টা ও সমন্বয়কদের বিভিন্ন বক্তব্য, তারেক জিয়ার দেশে আসা নিয়ে দীর্ঘসূত্রিতা, হাসিনা-জয়ের বিদেশে নির্বাসন, দেশে একের পর এক মামলা এবং খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রা— সবমিলিয়ে এ যেন রাজনীতিতে ওয়ান ইলেভেনের অসমাপ্ত মাইনাস ফোর-এরই এক নতুন চিত্রনাট্য।
বিএনএ/ সৈয়দ সাকিব, ওজি