বিএনএ ডেস্ক: বিএনএ নিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকম দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ধারাবাহিক নির্বাচনী হালচাল প্রচার করছে। এতে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ থেকে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর আসনভিত্তিক সাংগঠনিক হালচাল তুলে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছে বিএনএ নিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকম। আজ থাকছে মৌলভীবাজার-৪ আসনের হালচাল।
মৌলভীবাজার-৪ আসন
মৌলভীবাজার-৪ সংসদীয় আসনটি কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল উপজেলা নিয়ে গঠিত। এটি জাতীয় সংসদের ২৩৮ তম আসন।
পর্যটনের রাজধানী হিসেবে পরিচিত- প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ রূপমাধুর্যমন্ডিত মৌলভীবাজার ৪ আসনটি। সমতলভূমি, উঁচু-নিচু অসংখ্য টিলা ও পাহাড়, সারি সারি চা বাগান, রাবার বাগান, লেবু, আনারস, কাঁঠাল ও নাগা মরিচের বাগান রয়েছে এখানে। তেল, গ্যাস ও প্রাকৃতিক সম্পদেও ভরপুর।
আরও রয়েছে, মনিপুরী, খাসিয়া, গারোসহ অনেক নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। মাধবপুর লেক, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, হামহাম জলপ্রপাত, নয়নাভিরাম চা বাগান, হাইল হাওড়ের বাইক্কা বিল, শ্রীমঙ্গলের বাংলাদেশ চা-গবেষণা ইনস্টিটিউট, সাতগাঁওয়ের চা-কন্যা মনুম্যান্ট, শ্রীমঙ্গলে সাত রঙয়ের চাসহ অসংখ্য নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য।
পঞ্চম সংসদ নির্বাচন: আওয়ামী লীগের মোঃ আব্দুস শহীদ বিজয়ী হন
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই আসনে ভোটার ছিলেন ২ লাখ ৪৪ হাজার ২ শত ২৬ জন। ভোট প্রদান করেন ১ লাখ ৪৬ হাজার ১ শত ৩৮ জন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মোঃ আব্দুস শহীদ বিজয়ী হন। নৌকা প্রতীকে তিনি পান ৭৫ হাজার ৩ শত ২১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাতীয় পার্টির আহাদ মিয়া। লাঙ্গল প্রতীকে তিনি পান ৬০ হাজার ২ শত ১৫ ভোট ।
ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: বিএনপির শফিকুর রহমানকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগসহ সব বিরোধী দল এই নির্বাচন শুধু বর্জন করে ক্ষান্ত হয়নি, প্রতিহতও করে। নির্বাচনে বিএনপি,ফ্রিডম পার্টি এবং কিছু নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দল, অখ্যাত ব্যক্তি প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন। এই নির্বাচনে বিএনপির শফিকুর রহমানকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত এই সংসদের মেয়াদ ছিল মাত্র ১১ দিন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাশ হওয়ার পর এই সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
সপ্তম সংসদ নির্বাচন: আওয়ামী লীগের মোঃ আব্দুস শহীদ বিজয়ী হন
১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ২ লাখ ৩৭ হাজার ৬ শত ৬৬ জন। ভোট প্রদান করেন ১ লাখ ৭৯ হাজার ৯ শত ২১ জন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মোঃ আব্দুস শহীদ বিজয়ী হন। নৌকা প্রতীকে তিনি পান ৯১ হাজার ৮ শত ১১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাতীয় পার্টির আহাদ মিয়া। লাঙ্গল প্রতীকে তিনি পান ৫৯ হাজার ৮ শত ২৫ ভোট।
অষ্টম সংসদ নির্বাচন: আওয়ামী লীগের মোঃ আব্দুস শহীদ বিজয়ী হন
২০০১ সালের পহেলা অক্টোবর অষ্টম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ২ লাখ ৮৭ হাজার ৬ শত ৮৪ জন। ভোট প্রদান করেন ২ লাখ ১৮ হাজার ৬ শত ৮২ জন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মোঃ আব্দুস শহীদ বিজয়ী হন । নৌকা প্রতীকে তিনি পান ৯৬ হাজার ৩ শত ২৯ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির মুজিবুর রহমান চৌধুরী। ধানের শীষ প্রতীকে তিনি পান ৭০ হাজার ৩ শত ৬৪ ভোট।
নবম সংসদ নির্বাচন: আওয়ামী লীগের মোঃ আব্দুস শহীদ বিজয়ী হন
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ২ লাখ ৫০ হাজার ৩ শত ৭ জন। ভোট প্রদান করেন ২ লাখ ২১ হাজার ৯ শত ৮৩ জন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মোঃ আব্দুস শহীদ বিজয়ী হন। নৌকা প্রতীকে তিনি পান ১ লাখ ৩৪ হাজার ৭ শত ৪০ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির মুজিবুর রহমান চৌধুরী। ধানের শীষ প্রতীকে তিনি পান ৭৯ হাজার ৫ শত ৯৯ ভোট।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন: আওয়ামী লীগের মোঃ আব্দুস শহীদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মোঃ আব্দুস শহীদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধিনে র্নিবাচনের দাবিতে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এই নির্বাচনে অংশ গ্রহন করেনি।
একাদশ সংসদ নির্বাচন: আওয়ামী লীগের মোঃ আব্দুস শহীদ বিজয়ী হন
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৩ লাখ ৯৮ হাজার ৯ শত ৫০ জন। ভোট প্রদান করেন ৩ লাখ ১০ হাজার ২ শত ৬১ জন।
নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন ৪ জন। নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের মোঃ আব্দুস শহীদ, ধানের শীষ প্রতীকে মুজিবুর রহমান চৌধুরী, হাতপাখা প্রতীকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ছালাউদ্দীন এবং উদিয়মান সূর্য প্রতীকে গনফোরামের শান্তি পদ ঘোষ প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মোঃ আব্দুস শহীদ বিজয়ী হন। নৌকা প্রতীকে তিনি পান ২ লাখ ১১ হাজার ৬ শত ১৩ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির মুজিবুর রহমান চৌধুরী। ধানের শীষ প্রতীকে তিনি পান ৯৩ হাজার ২ শত ৯৫ ভোট। কারচুপির অভিযোগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন বর্জন ও ফলাফল প্রত্যাখান করে।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, শুধুমাত্র ষষ্ঠ সংসদে বিএনপি এবং পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, নবম, দশম ও একাদশ সংসদে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়।
দৈবচয়ন পদ্ধতিতে জরিপ
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনএ নিউজ টুয়েন্টি ফোর এর গবেষণা টিম দৈবচয়ন পদ্ধতিতে সারাদেশে জরিপ চালায়। জরিপে অংশগ্রহণকারি বেশীরভাগ ভোটার ১৯৯১ সালের পঞ্চম, ১৯৯৬ সালের সপ্তম, ২০০১ সালের অষ্টম ও ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরেপক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তারই ভিত্তিতে বিএনএ নিউজ টুয়েন্টি ফোর মৌলভীবাজার-৪ আসনে পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও নবম এই ৪টি নির্বাচনের প্রদত্ত ভোটের পরিসংখ্যানকে মানদন্ড ধরে আওয়ামী লীগ,বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত ইসলামীর সাংগঠনিক শক্তি বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি কল্পানুমান উপস্থাপনের চেষ্টা করেছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, মৌলভীবাজার-৪ সংসদীয় আসনে ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ভোট প্রদান করেন ৫৯.৮৪% ভোটার। প্রদত্ত ভোটের মধ্যে আওয়ামী লীগ ৫১.৫৪%, বিএনপি ৪.৫১%, জাতীয় পাটি ৪১.২০%, জামায়াত ইসলামী ১.০৬% স্বতন্ত্র ও অন্যান্য ১.৬৯% ভোট পায়।
১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে ভোট প্রদান করেন ৭৫.৭০% ভোটার। প্রদত্ত ভোটের মধ্যে আওয়ামী লীগ ৫১.০৩%, বিএনপি ১৩.৬১% জাতীয় পাটি ৩৩.২৫%, জামায়াত ইসলামী ১.৪৯% স্বতন্ত্র ও অন্যান্য ০.৬২% ভোট পায়।
২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ভোট প্রদান করেন ৭৬.০১% ভোটার। প্রদত্ত ভোটের মধ্যে আওয়ামী লীগ ৪৪.০৫%, ৪ দলীয় জোট ১৫.৮৮%, জাতীয় পাটি ৭.৭৬%, স্বতন্ত্র ও অন্যান্য ৩২.৩১% ভোট পায়।
২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে ভোট প্রদান করেন ৮৬.০৯% ভোটার। প্রদত্ত ভোটের মধ্যে ১৪ দলীয় জোট ৬১.১২%, ৪ দলীয় জোট ৩৬.৯৩% স্বতন্ত্র ও অন্যান্য ১.৯৫% ভোট পায়।
মৌলভীবাজার-৪ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের মোহাম্মদ আব্দুস শহীদ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি একক প্রার্থী।
বিএনপি থেকে মনোনয়ন চাইবেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী প্রকাশ হাজী মুজিব। তিনি দলের একক প্রার্থী। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দল তাকে মনোনয়ন দেয়।
কৌশলগত কারণে একাদশ সংসদ নির্বাচনের মতো তাঁর ছেলে আশিক মুঈদ চৌধুরী চিশতী ও মনোনয়ন চাইবেন।
তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, মৌলভীবাজার-৪ আসনটি আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চা শ্রমিকদের ভোটাধিকার দেন। সেই থেকে চা শ্রমিকদের নৌকা মার্কার প্রতি বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। দেশের ১৬৩টি চা বাগানের মধ্যে ৯২টি চা বাগানেই এই মৌলভীবাজার-৪ আসনে। বৈচিত্র্যময় এই আসনে শুধু চা বাগানই নয়, এখানে আছে মনিপুর, গারো, খাসিয়াদের মতো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ। মৌলভীবাজার জেলার সবচেয়ে বেশি চা বাগান অধ্যুষিত এই আসনে যে কোনো প্রার্থীর জয়-পরাজয় নির্ধারণ হয় চা শ্রমিকদের ভোটে। চা শ্রমিকদের ভোট নির্ভর এই আসনে, টানা সাত বার জয়ী আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা আব্দুস শহীদ। দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতাসীন থাকার কারণে এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ড করেছে। সাংগঠনিক শক্তির পাশাপাশি উন্নয়ন আওয়ামী লীগের বাড়তি ভরসা।
বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি মজবুত নয়। কিন্তু প্রচুর ভোট রয়েছে। বিএনপি চায় এই আসনটি পুনরুদ্ধার। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ চায় ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হলে জাতীয় সংসদের ২৩৮ তম সংসদীয় আসন (মৌলভীবাজার-৪) আসনটিতে আওয়ামী লীগই বিজয়ী হবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিএনএ/ শাম্মী, রেহানা, ওজি, ওয়াইএইচ/এইচ এ মুন্নী