22 C
আবহাওয়া
৩:২০ পূর্বাহ্ণ - নভেম্বর ২৩, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » নীরবে কেটে গেল চট্টগ্রাম গণহত্যা দিবস

নীরবে কেটে গেল চট্টগ্রাম গণহত্যা দিবস

নীরবে কেটে গেল চট্টগ্রাম গণহত্যা দিবস

বিএনএ,চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনের কারণে ঐতিহাসিক রক্তস্নাত  ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা দিবস’ নীরবে কেটে গেল। অন্যান্য বছরের মতো পালিত হয়নি দিবসটি। তবে নিহতের পরিবার-স্বজন এবং বোধন আবৃত্তি পরিষদ চট্টগ্রামের আয়োজনে শহীদদের স্মৃতি  স্তম্ভে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে দিবসটি পালিত হয়।

রোববার (২৪ জানুয়ারি) সন্ধ্যা ৬টায় ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা দিবস’ স্মরণে কোর্ট বিল্ডিং শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আলোচনা ও আবৃত্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বোধন আবৃত্তি পরিষদ। এতে সভাপতিত্ব করেন বোধনের সভাপতি আবদুল হালিম দোভাষ।

বক্তব্য রাখেন মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান মাকসুদ, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা অ্যাড. সুস্বপন কৃষ্ণ বিশ্বাস, চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও মহানগর আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাড. শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি পিনাকী দাশ, নাট্যব্যক্তিত্ব অ্যাড. দীপক চৌধুরী, সম্মিলিত আবৃত্তি জোট চট্টগ্রামের সভাপতি অঞ্চল চৌধুরী এবং বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহসভাপতি রিয়াজ হায়দার চৌধুরী।
‘চট্টগ্রাম গণহত্যা দিবস’ স্মরণে কোর্ট বিল্ডিং শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আলোচনা ও আবৃত্তি অনুষ্ঠান

এ সময় বক্তারা এমন আয়োজনের জন্য বোধনকে ধন্যবাদ জানান। তাঁরা ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারির নৃশংস গণহত্যার ঘটনার স্মৃতিচারণ করে বলেন, সেই রক্তাক্ত সময়ে স্বৈরশাসক বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি চালায় এবং ঘটনাস্থলে চট্টগ্রামে তৎকালীন আন্দোলনরত অসংখ্য জনতা গুলিবিদ্ধ হয়। এতে ২৪ জন নির্মমভাবে প্রাণ হারায়। তাদের আত্মত্যাগে আমাদের এই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়। আর যেন এই বাংলাদেশে ২৪শে জানুয়ারির পুনরাবৃত্তি না ঘটে এবং গণতন্ত্র সমুন্নত থাকে।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অ্যাড. নারায়ণ প্রসাদ বিশ্বাস, সুজিত রায়, প্রবীর পাল, শিমুল নন্দী, কবি শিপ্রা দাশ, মাইনুল আজম চৌধুরী, তৈয়বা জহির আরশি, সেহেলী হাসনাত, ইকবাল হোসেন প্রমুখ।

শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আবৃত্তি পরিবেশন করেন আমন্ত্রিত আবৃত্তিশিল্পী অনির্বাণ চৌধুরী এবং বোধনের আবৃত্তিশিল্পী জাভেদ হোসেন, অসীম দাশ, যশস্বী বণিক,সন্দীপন সেন একা, প্রিয়ন্তী বড়ুয়া, দুর্দানা মারজান, পৃথুলা চৌধুরী, অনিমেষ পালিত, তূর্ণা দাম, প্রজ্ঞা পারমিতা, মৃত্তিকা চক্রবর্তী, মেঘা সেন, সুমি মল্লিক ও হামিমা জামিল রুমা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বোধনের সাধারণ সম্পাদক আবৃত্তিশিল্পী প্রণব চৌধুরী।

১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে জনসভা করবেন। তা নানাভাবে চট্টগ্রাম শহরে প্রচার করা হয়। আগের দিন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ ঘোষণা দেয়, লালদীঘির মাঠে কোনো জনসভা করতে দেওয়া হবে না। স্টেজ বানানোর সরঞ্জাম পুলিশ বাজেয়াপ্ত করে।

পুলিশের এমন আদেশ জারির কারণে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় শেখ হাসিনা পার্শ্ববর্তী জেলা পরিষদ মার্কেটের বারান্দা থেকে তাঁর বক্তব্য দেবেন । সকাল ১১টা নাগাদ তাঁকে বহনকারী বাংলাদেশ বিমানটি চট্টগ্রাম পৌঁছে। বিমান বন্দর থেকে চট্টগ্রামের নেতাকর্মীরা একটি খোলা ট্রাকে তোলেন নেত্রীকে। পথে পথে তিনি একাধিক পথসভায় বক্তৃতা দেন। দুপুর ২টা নাগাদ তিনি লালদীঘির দুইশ’ গজ দূরে কোতোয়ালি থানার মোড়ে পৌঁছান। চারদিকে তখন নেতাকর্মীদের এরশাদ বিরোধী স্লোগান। হঠাৎ কোনো উস্কানি ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের মোড়ে দাঁড়ানো পুলিশ সদস্যরা শেখ হাসিনার ট্রাক লক্ষ্য করে গুলি ও টিয়ার শেল ছুড়তে থাকেন। উদ্দেশ্য একটাই, শেখ হাসিনাকে হত্যা করা।

উপস্থিত নেতাকর্মী, সাধারণ জনতা পুলিশের ছোড়া গুলি আর টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ার কারণে পিছু হটে দিক্বিদিক ছুঁটতে থাকে। শেখ হাসিনাকে রক্ষা করার জন্য নেতাকর্মীরা তাঁর চারপাশে মানব প্রাচীর তৈরি করেন। ট্রাকে অবস্থানরত আইনজীবীরা শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রাকটি নিয়ে পাশের রাস্তা দিয়ে আদালত পাহাড়ে ওঠে পড়েন। তখন চারদিকে গুলিবিদ্ধ অসংখ্য মানুষ কাতরাচ্ছে। অনেক মরদেহ পাশের বড় ড্রেন ও রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কর্মীরা তাদের বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যায়। রাতে পুলিশ ২৪টি মরদেহ হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যায়, যার মধ্যে সব ধর্মের মানুষই ছিল। সেই রাতেই জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সব মরদেহকে অভয় মিত্র শ্মশানঘাটে পুড়িয়ে ফেলা হয়। দুইশতাধিক মানুষ আহত হয় তখন।

নিহত যাঁদের পুঁড়িয়ে ফেলা হয় তাঁরা হলেন, হাসান মুরাদ, মহিউদ্দিন শামীম, স্বপন কুমার বিশ্বাস, এথলেবারট গোমেজ কিশোর, স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, রমেশ বৈদ্য, বদরুল আলম, ডিকে চৌধুরী, সাজ্জাদ হোসেন, আব্দুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, বিকে দাশ, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দিন, চান্দ মিয়া, মসর দত্ত, হাশেম মিয়া, মো. কাশেম, পলাশ দত্ত, আব্দুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ, মো. শাহাদাত।

এদিকে একটু সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে শেখ হাসিনাকে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর সার্সন রোডের বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন শহরে নেমে আসে এক ধরনের নিস্তব্ধতা, যেমনটি কারফিউর সময় দেখা যায়। পেশাজীবীদের সঙ্গে শেখ হাসিনার মতবিনিময়ের অনুষ্ঠানটিও বাতিল করতে হয়। কারণ পুরো এলাকা পুলিশ ঘিরে ফেলেছিল।

দু’বছর পর ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ এরশাদের পতনের পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ আইনজীবী মো. শহীদুল হুদা বাদী হয়ে ওই মামলা করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মামলাটি পুনরায় প্রাণ ফিরে পায়। আদালতের আদেশে মামলাটির তদন্তের ভার পড়ে সিআইডির ওপর।

সিআইডি ১৯৯৭ সালের ১২ জানুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে আদালতে। আবারও আদালতের নির্দেশে অধিকতর তদন্ত শেষে ১৯৯৮ সালের ৩ নভেম্বর পুলিশের আট সদস্যকে আসামি করে দ্বিতীয় দফায় অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি চাঞ্চল্যকর এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়।

প্রায় ৩২ বছর পর ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বিশেষ জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক বিচারপতি মো. ইসমাইল হোসেন একটি হত্যাকাণ্ড, যাকে চট্টগ্রাম গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করা হয় তার রায় ঘোষণা করেছেন ঘটনার ৩২ বছর পর। মামলার বাদী আইনজীবী মো. শহীদুল হুদা কয়েক বছর আগে ইন্তেকাল করেছেন। রায়ে আদালত পাঁচজন পুলিশ সদস্যকে ২৪ জন মানুষ হত্যার দায়ে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন। এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা।

যাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে তারা হলেন- মমতাজ উদ্দিন, মোস্তাফিজুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, গোপাল চন্দ্র (জেসি) মণ্ডল ও আব্দুল্লাহ। তারা প্রত্যেকেই পুলিশের সাবেক সদস্য। তাদের মধ্যে একমাত্র গোপাল চন্দ্র পলাতক, বাকিরা কারাগারে আছেন।

গণহত্যা মামলার বাদি ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শহিদুল হুদার ছেলে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ এরশাদ হোসেন বলেন, ১৯৯২ সালে ৫ মার্চ ঘটনায় জড়িত ৪৬ আসামির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার পর থেকে সিএমপির তৎকালীন কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদা আমার বাবাকে প্রাণনাশের হুমকি দেন। গত বছর ২০ জানুয়ারি আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে আমরা অন্য সবার মতো সন্তুষ্ট।

তিনি বলেন, এ মামলার রায়ে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছে। রায়ে প্রমাণ হলো, অপরাধী যে-ই হোক এদেশের মাটিতে বিচার একদিন হয়ই। ২০০৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শহিদুল হুদা।

আলোচিত এ মামলার মোট সাক্ষী ১৬৭ জন। ২০২০ সালের বছরের ১৪ জানুয়ারি ৫৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে সাক্ষ্য কার্যক্রম শেষ হয়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আওয়ামী লীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ড. অনুপম সেন, সাংবাদিক অঞ্জন কুমার সেন ও হেলাল উদ্দিন চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী মামলায় সাক্ষ্য দেন।

বিএনএনিউজ/মনির

Loading


শিরোনাম বিএনএ